কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট ঘুরে: নির্জন কাঁচা সড়কের কোনো গাছের নিচে কিংবা বৃষ্টির অলস সময়ে ঘরের কোণে অখণ্ড অবসর উদযাপনে দুই তরুণের বাঘবন্দি বা ষোলঘুঁটি খেলার ব্যস্ততা চোখে পড়ে না আগের মতো।
নেই বাদল দিনে কাদা মাখা শরীরে কিংবা ধুলো উড়া মাঠের কোণে হা-ডু-ডু কোট!
অথচ এগুলোই বাংলা আর বাঙালির প্রাণের খেলা।
সেসব জায়গা দখল করে নিয়েছে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সিরিয়াল, ক্রিকেট কিংবা ক্যারামের মতো বিদেশি খেলা। এখন অজগাঁয়ের সেই ছোট্ট ছেলেটিও ৠাকেট হাতে টেনিস কিংবা ব্যাডমিন্টন খেলতে নেমে যায়।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো উত্তরবঙ্গেও ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলো গ্রামীণ খেলাগুলো। গ্রামে-গঞ্জে সমাজ বিবর্তনে বিলুপ্তি ঘটছে দাড়িয়াবান্দা, হা-ডু-ডু, লাঠিখেলারও।
পল্লী গবেষক পঞ্চানন রায় বলেন, আগে বিভিন্ন গ্রামীণ উৎসবে মেলা হতো। সেখানে প্রতিযোগিতামূলক নানা খেলার আয়োজনও থাকতো।
‘এখন আকাশ সংস্কৃতি আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ খেলাগুলো হচ্ছে না। বুদ্ধির খেলা ষোলঘুঁটিও নেই। ’
তবে লোকজ খেলাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে সর্বস্তরের মানুষের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
খোলা জায়গায় দাগ কেটে ছক তৈরি করে খেলা হয় দাড়িয়াবান্ধা। দুই দলের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক একটি খেলা। প্রতি দলে পাঁচ-সাতজন খেলোয়াড় থাকতে পারে। প্রত্যেকটি ঘরের সঙ্গে আঁকা রেখার মাঝে দলের সদস্যরা পৃথকভাবে অবস্থান নেয়।
প্রথম ঘর থেকে বের হয়ে প্রতিটি খেলোয়াড় বিপক্ষ খেলোয়াড়ের ছোঁয়া বাঁচিয়ে ঘরগুলো ঘুরে গদিঘরে ফিরে আসতে চেষ্টা করে। যে কোনো একজন সফল হলে দলের জিত ও পয়েন্ট হয়। অপরপক্ষে কোনো একজনের ছোঁয়া পড়লে ওই দল পয়েন্ট ছাড়াই ‘দান’ হারায়। একইভাবে পরবর্তী দল খেলে।
খেলাটি উত্তরবঙ্গ লাগোয়া ভারতের কুচবিহারেও প্রচলিত বলে পশ্চিমবঙ্গের লেখক শ্রী উপাসুর বইয়ে উল্লেখ রয়েছে।
হা-ডু-ডু এতোটাই জনপ্রিয় ছিলো যে, বাংলাদেশের জাতীয় খেলার মর্যাদা পেয়েছে। অথচ বর্তমান প্রজন্মের শহুরে ছেলেদের মধ্যে এর পরিচিতিই নেই!
শক্তি ও সাহসের খেলা বলে এতে তরুণরা অংশ নিতো! দুই দলের এ খেলা শারীরিক ব্যয়ামও বটে। নরম মাটির ওপর দাগ কেটে খেলা হয়।
‘হা-ডু-ডু ছাড়াও ঢুক্কু ঢুক্কু এলেঙ্গা তোরা একটা নিলাম গা’ ছড়া কেটেও দম নিয়ে বিপক্ষের দিকে ছুটে যায় অপরপক্ষের খেলোযাড়।
সচরাচর দেখা যায় না বৌচি খেলার, বিলুপ্ত প্রায় মেয়েলী খেলা কুতকুতও।
বর্তমান প্রজন্ম প্রসঙ্গে কুড়িগ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘প্রচ্ছদ’র আহ্বায়ক দুলাল বোস বলেন, গ্রামীণ খেলাগুলো নেই বলে তরুণদের মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হচ্ছে না।
তার সঙ্গে একই ভাবনা কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল ভৌমিকেরও।
বললেন, লোকজ খেলাগুলো মানসিক ও শারীরিক জড়তা থেকে উত্তরণ ঘটায়। জিমে গিয়ে ব্যায়াম করতে হতো আগে। কয়েক বছর আগেও ছেলে-মেয়েরা মাঠে এসব খেলা খেলতো।
‘এখন গ্রামে কালেভদ্রে দেখা মিললেও শহুরে ছেলে-মেয়েরা টিভিতে সিরিয়াল দেখে কিংবা ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় ব্যয় করছে। ’
এতে সমাজের অবক্ষয় ঘটছে, বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা সৃষ্টিশীল জাতি হিসেবে তরুণ প্রজন্ম গড়ে ওঠছে না বলে মনে করেন তিনি।
আরও পড়ুন..
**লোকজ সংস্কৃতিতে চলে পানের আপ্যায়ন
** বাদল দিনে নেই বৃষ্টির খনা
** বাহে শোন মোর ভাওয়াইয়া গান
** ‘আয়সাই আব্বাস গাইলেন হাঁকাও গাড়ি চিলমারী’
** আহা! সেকি সুর শিরিষের সারিন্দায়! (ভিডিও)
** হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দর এ রে...
** বাংলার প্রাণের কাছে বাংলানিউজ, সঙ্গী হোন আপনিও
** শেকড়ের সন্ধানে উত্তর জনপদে বাংলানিউজের মাহবুব ও নূর
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৬
এমএ/জেডএম