লালমনিরহাট থেকে: সুরে-বেসুরে গলায় আঞ্চলিক ভাষায় নানী-দাদিদের গীত, নৌকায় কিংবা পালকিতে ছড়ে নতুন বউ আনতে যাওয়া-আবহমান বাংলার যেকোনো গ্রামের চিত্র।
মাইক, সাউন্ডবক্সসহ নিত্যনতুন বিনোদনের যান্ত্রিক সভ্যতার মধ্যে হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যবাহী বিয়ের গীত অজগাঁয়ে এখনও প্রচলিত!
হাজার বছরের এ ধারা প্রবেশ করেছে বাঙালির লোকজ সংস্কৃতিতে, তাই রীতি হিসেবেই এটা চর্চা করেন গাঁয়ের সহজ-সরল মানুষরা।
‘বাহের দেশ’ রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই এখনও পারিবারিক ও যে কোনো সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে গ্রামের মেয়েরা একক বা দলবদ্ধভাবে গেয়ে চলেন এ লোকগীতি।
বিশেষ করে শিশুদের প্রথম মুখে ভাত, জন্মের পর অনুষ্ঠান কিংবা বিয়েতে গায়ে হলুদে এ গীত পরিবেশন করা হয়।
কালের পরিবর্তনে শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত সমাজে গ্রামাঞ্চলে খুব একটা দেখা না গেলেও নিম্মবিত্ত-মধ্যবিত্তের অনুষ্ঠানগুলোতে লোকজ সংস্কৃতির এ অনুষঙ্গকে চর্চা করা হয় বলে জানালেন স্থানীয়রা।
কাকিনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন,লোকজ সংস্কৃতি বলতে এখন মেয়েলী গীত-ই কিছুটা টিকে আছে। আর পালাগান,যাত্রাপালা হয় না বললেই চলে।
‘তবে পহেলা বৈশাখ ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝে ভাওয়াইয়া, লাঠিখেলার আয়োজন হয়ে থাকে। ’
মেয়েলী গীতে বিভিন্ন বয়সের নারীরা অংশ নেন। এসব নিরক্ষর বধূরাই এ গানের কথা ও সুর করেন। এ ক্ষেত্রে বর-কনে কিংবা শিশুর সর্ম্পকে দাদী-নানী এবং ভাবীরা হন অপেশাদার এ ‘গীতালুরা’।
তবে কোনো কোনো অঞ্চলে পেশাদার গীতালুর কথা শোনা গেলেও উত্তরবঙ্গে প্রবীনদের কেউ বিষয়টি জানাতে পারেননি।
কুড়িগ্রামের চিলমারীর আশিধ্ব আবদুল কায়উম জানান, কোনো বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই গীত গেয়ে হাসি ঠাট্টা,কৌতুক ও হাস্যরস করেন গ্রামাঞ্চলের নারীরা।
‘নারী মনের দু:খ কষ্ট বর্ণনা থাকে এসব করুণ ও আবেগধর্মী গীতে। যা শ্রোতাদের মনে কেটে যেতো। ’
বিয়ে ছাড়াও বষা ছাড়াও অবসরে গীত গেয়ে মনের চাপা কথা প্রকাশ করেন তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র বিধৌত অঞ্চলের গৃহস্থ বধূরা।
উত্তর জনপদে এখনও খালি গলায় ‘কন্যা ডাক দেও তোর জননী না মাইরে/মাওদিয়া যাওক সোনা মুখে হলদিরে/হলুদা, ডাক দেও তোর জনমদাতা বাপেরে/বাবা দিয়ে যাউক তোর সোনা মুখে হলদিরে, ‘আলুয়ার চালে কাঞ্চন দুধে ক্ষীরোয়া পাকালাম, সেই না ক্ষীরোয়া খেতে গরমি লেগেছে/কোথায় আছ বড়ভাবী পাক্কা হিলোয়রে’, ‘গহনা আনিছেন দুলা মিয়া দেখানতো হামাকে/সবই জিনিসি আনিছি গুলজান বিবিনথুয়া ছারিছি দেশে’ গাওয়া হয়।
তবে কোনো কোনো অঞ্চলে ঢোলক ব্যবহারের কথা উল্লেখ রয়েছে বাংলাপিডিয়ায়।
বলা আছে,বিয়েতে গায়ে হলুদ, মেহেদি তোলা,জল ভরা,বর-কনের গোসল,কনে সাজানো, বর বরণ,কনে বিদায়ের সময় এ গীত গাওয়া হয়।
বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে নগরায়নের প্রভাবে এসব গীতের চর্চা ও ব্যাপকতা অনেকাংশে কমে গেছে। এর জায়গায় এসেছে হিন্দিসহ বিভিন্ন আধুনিক গান।
কাকিনা মহিমা রঞ্জন স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান বলেন,এখন শহরে কিংবা গ্রামেও গীতের বদলে গান বাজানো হয়। অনেক সময় শিক্ষাবঞ্চিত গৃহিণীদের গীতগুলোই বাজাতে শোনা যায়-যেগুলো বিভিন্ন শিল্পীরা পরে ক্যাসেট করেছেন। ’
‘তবে ঐতিহ্য রক্ষায় নানী-দাদীদের মতো গাওয়াই উচিৎ, বলে মত তার।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১৬
এমএ/
** ‘নিজ সংস্কৃতি নিয়ে হীনমণ্যতা বিলুপ্তির কারণ’
** দাড়িয়াবান্ধা নেই, বিলুপ্ত বৌচি
** লোকজ সংস্কৃতিতে চলে পানের আপ্যায়ন
** বাদল দিনে নেই বৃষ্টির খনা
** বাহে শোন মোর ভাওয়াইয়া গান
** ‘আয়সাই আব্বাস গাইলেন হাঁকাও গাড়ি চিলমারী’
** আহা! সেকি সুর শিরিষের সারিন্দায়! (ভিডিও)
** হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দর এ রে...
** বাংলার প্রাণের কাছে বাংলানিউজ, সঙ্গী হোন আপনিও
** শেকড়ের সন্ধানে উত্তর জনপদে বাংলানিউজের মাহবুব ও নূর