পঞ্চগড় থেকে: সত্যপীরের গান, উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলায় লোকাচার। নিঃসন্তান দম্পতি, রোগবালাই থেকে মুক্তিসহ নানা আশাপূরণের জন্যে গ্রামের নিরক্ষর মানুষরা হাজার বছর ধরে পালন করে আসছেন লোকাচারটি।
একটা সময় বর্ষাকাল বাদে বছরের অন্য সময় প্রায় প্রতি রাতেই গ্রামের কোনো না কোনো বাড়িতে বসতো এ গানের আসর।
বৈজ্ঞানিক কিংবা ধর্মে কোনো ব্যাখ্যা না থাকলেও সত্য যুগের বিশ্বাসে এ গানের আয়োজন করেন সাধারণ মানুষ।
আগের জৌলুস হারালেও উত্তরের জেলা পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁওয়ে এ গানের আসর বসে এখনও। পালার মূল শিল্পীকে বলা হয় ফকির। যিনি তন্ত্রে-মন্ত্রে সিদ্ধ হস্ত বলেই বিশ্বাস!
প্রাণের এ লোকসংস্কৃতির সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, রোগ বালাই থেকে মুক্তি পেতে কিংবা অন্য যেকোনো আশা পূরণের লক্ষ্যে সত্যপীরের পালা গাওয়ানো হয়। এজন্যে পেশাদার বা অপেশাদার দল থাকে। যারা অর্থের বিনিময়ে গান করেন।
তবে কালের আবর্তনে পেশা পরিবর্তনের হিরিকের সময় অনেকেই নিছক ঐতিহ্য রক্ষা কিংবা মনের আনন্দে আকড়ে আছেন সত্যপীরের গানের দলকে।
তাদের একজন পঞ্চগড় জেলা সদরের জগদল জিলাশি পাড়ার বশির উদ্দিন বিশু। চার ছেলে-মেয়ের জনক গান পাগল বিশুর গানের প্রতি ভালোবাসা জন্মে শৈশবেই।
তার ভাষায়, বড়ভাই সত্যপীরের গানের দলের ম্যানেজার ছিলেন। তার কাছ থেকে বিষয়টি শিখেছি। এরপর নিজেই গানের দলে যুক্ত হই। প্রথমে একটি দল করি, এরপর চারটি। বর্তমানে তিনটি দলের দেখভাল করেন তিনি।
বিশু বিভিন্ন এলাকার মানুষের কাছ থেকে গানের তারিখ ঠিক করেন। এরপর দল নিয়ে পালা গেয়ে আসেন।
সত্যপীরের পালা প্রসঙ্গে এই প্রবীণ বলেন, হঠাৎ বোবো হয়ে যাওয়া, নিঃসন্তান দম্পতি,পাগল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি থেকে মুক্তি পেতে অনেকে এ পালা গাওয়ানোর জন্যে মানত করে।
‘রোগ থেকে মুক্তি পেলে অথবা সন্তান সন্তুতি হলে এ পালাটি গাওয়া হয়’।
তিনি বলেন, এ গানের দলে একজন ফকির (বয়াতি) থাকেন। একজন থাকেন ডায়না, আরেকজন জোকার। বাকিরা তাদের সঙ্গে গানে যুক্ত হন। মূলত নানা অঙ্গ-ভঙ্গি করে ও হাস্যরস করে মানুষকে আনন্দ দেন ফকির, ডায়না আর জোকারই।
‘ফকির এ গানের বিভিন্ন পালা স্বপ্নে শিখে থাকেন। তিনি অনেক তন্ত্র-মন্ত্রও জানেন। সত্যপীরের গানের পালা শুরু হলে এক থেকে আট রাত পর্যন্ত লেগে যায়। আর তা মুখস্ত গেয়ে যান ফকির’।
আর এ পালার মূল আর্কষণ হচ্ছে ছেলে মেয়ে হওয়া। একটি ছেলেকে শাড়ি পড়িয়ে মেকআপ করিয়ে মেয়ে সাজানো হয়। যিনি রাতভর দর্শকদের মাতিয়ে রাখেন।
সত্যপীরের গানে তবলা, হারমোনিয়াম,দোতরা, বাঁশি, করতাল ছাড়াও দেশীয় বাদ্য ব্যবহার করা হয়। একটি পালায় সাধারণত সাতজন লোক লাগে। তবে পাঁচজনকে দিয়েও গাওয়ানো যায়।
আগের মতো আসর হয় না জানিয়ে বিশু বলেন,স্বাধীনতা কিংবা এর আগে অনেক আসরের ডাক পেতাম। এখন মাসে কিংবা দুইমাসে একটির জন্য ডাক পাই।
আর একটি পালার জন্য সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা পাওয়া যায়। সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা যা দিয়ে সংসার চালিয়ে যেতে কষ্ট হয়।
শিল্পীদের করুণ অবস্থার কথা তুলে ধরে লোকজ শিল্পী বিশু বলেন,যারা এ কাজ করেন, তাদের খুব অভাব। দিনে এনে দিন খাইয়ের মতো অবস্থা।
‘অনেকে পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। এরপরও কৃষিসহ অন্যান্য কাজে নিয়োজিত থেকেও মনের আনন্দে আর বাপ দাদার ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে এ গান ধরে রেখেছি’।
সত্যপীরের গানে ‘আমিরুল বাদশা, বজরা বিবি, হরকতির বাদশা, বাহরাম বাদশা, হিরামতির পালা, কালুরাজাসহ আটারোটি পালা গাওয়া হয় বলে জানান দলের ফকির ছায়ফুল ইসলাম।
জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে বসে পেশায় অটোরিকশাচালক ছায়ফুল বাংলানিউজকে বলেন, স্বপ্নে সত্যপীরের পালা শিখেছি। আমার পীরের নির্দেশে এখন গেয়ে যাই।
পঞ্চগড় শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক প্রহল্লাদ চন্দ্র বর্মণ বলেন, বাংলার আনাচে কানাচে শিল্পীদের নিয়ে আমরা আমাদের লোকসংগীতকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। এজন্য শিল্পকলা একাডেমির পরিকল্পনা আছে।
এদিকে পঞ্চগড়সহ উত্তরবঙ্গের প্রচলিত লোকজসংস্কৃতি বৈরাগী-বৈরাগিণী বা বোষ্টম-বোষ্টমীর গান। একতারা হাতে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করে বেড়াতেন তারা।
বর্তমান প্রজন্ম সুনীলের কবিতায় বোষ্টমীর কথা জানলেও বাস্তবে দেখে না বোষ্টম-বোষ্টমীকে।
** বিলাসী মহেন্দ্রের সাক্ষী হাওয়াখানা
**গাঁয়ের বধূর মনের কথা মেয়েলী গীত
** ‘নিজ সংস্কৃতি নিয়ে হীনমণ্যতা বিলুপ্তির কারণ’
** দাড়িয়াবান্ধা নেই, বিলুপ্ত বৌচি
** লোকজ সংস্কৃতিতে চলে পানের আপ্যায়ন
** বাদল দিনে নেই বৃষ্টির খনা
** বাহে শোন মোর ভাওয়াইয়া গান
** ‘আয়সাই আব্বাস গাইলেন হাঁকাও গাড়ি চিলমারী’
** আহা! সেকি সুর শিরিষের সারিন্দায়! (ভিডিও)
** হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দর এ রে...
** বাংলার প্রাণের কাছে বাংলানিউজ, সঙ্গী হোন আপনিও
** শেকড়ের সন্ধানে উত্তর জনপদে বাংলানিউজের মাহবুব ও নূর
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৪,২০১৬
এমএ/বিএস