জীবনের এক ভিন্ন গল্পের অধিকারী তিনি। পঙ্গুত্ব হার মেনেছে যার কাছে। সবকিছু থেকেও কিছুই নেই যার!তার একটা ঘর। একটাই বসবাসের কক্ষ। একটাই বেঁচে থাকার একমাত্র দোকান। এই ছোট্ট ব্যবসাকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন যা আয়-রোজগার হয় তা দিয়েই কোনোমতে চলেন তিনি। জীবনের স্বাভাবিক গতি থেকে পিছিয়ে পড়া এই পঙ্গু মানুষটির নাম মাহমুদুর রহমান জগলু। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ব্রাক্ষ্মণবাজার ইউনিয়নের কুনাগাঁও গ্রামে বাস করেন। পঙ্গুত্ব সত্ত্বেও অলস হয়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকেননি তিনি। আপন চেষ্টায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। খুলেছেন ‘প্রতিবন্ধী স্টোর’ নামে একটি ব্যতিক্রমী দোকান। এলাকার ছোট ছোট শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা পর্যন্ত আসেন তার দোকানে। পণ্য ক্রয়ের জন্য কিংবা খোশগল্প-আড্ডায় মুখরিত হতে। লোকপ্রিয় এই মানুষটি সদা হাস্যময়। জীবনের নানান দুর্ঘটনার পরও তার মুখাবয়ব থেকে উবে যায়নি হাসি। বরং সদা হাস্যোজ্জ্বল তিনি। গ্রামের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। গ্রামে নতুন কেউ এলেই তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে পরিচিত হবার চেষ্টা করেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৬ বছর তিনি সৌদি আরবে টয়েটা কোম্পানিতে চাকুরি করেছেন। দেশে ফিরে আসেন ২০০৯ সালে। একটি ভুল অপারেশনে তিনি শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে যান ২০১০ সালে। পরবর্তীকালে চট্টগ্রামের পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে মৌলভীবাজারে সিআরপি সংস্থার আশ্রয়প্রার্থী হন। সংসারে স্ত্রী এবং দুই পুত্রসন্তান তার। কিন্তু তারা থেকেও যেন নেই। ২০১০ সালে তিনি অসুস্থ হবার পর স্ত্রী চাকরি পেয়ে আলাদা হয়ে কুলাউড়া শহরে থাকেন। ভুলেও স্ত্রী তার দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে একটিবারও তাকে চোখের দেখা দেখতে আসেন না। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলছিলেন জগলু। মাহমুদুর রহমান জগলু বাংলানিউজকে বলেন, পঙ্গুত্ব জীবনের শেষ কথা নয়। আমি কাজ করে খেতে চাই। কাজ করে বেঁচে থাকতে চাই। তাই সিআরপি-র কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন আহমেদের পরামর্শ এবং সহযোগিতায় এই ‘প্রতিবন্ধী স্টোর’ খুলে ব্যবসা করছি। জীবন চালাচ্ছি। আমার বড়ছেলের নাম অহি। পড়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে। ছোটছেলের নাম ওমর। পড়ছে ৩য় শ্রেণিতে। বছরে একবারও যদি ছেলে দুটোকে দেখতে পারতাম তবে আমার আর কোনো কষ্ট থাকতো না। এখন আমার ভাই-ভাতিজারাই আমার দেখভাল করে। ‘মনকে বুঝ দিয়েছি যে, আমি এখনো সৌদিতেই রয়েছি। তাই আমার ছেলেদের সঙ্গে আর দেখা হয় না। আমি যদি সুস্থভাবে হাঁটতে পারতাম, ঘুরে বেড়াতে পারতাম তাহলে সপ্তাহে দু-তিনদিন আমার দুই ছেলেকে গিয়ে দেখে আসতে পারতাম’—বলতে বলতে দু’চোখ জলে ভরে উঠছিল জগলুর। বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল দেয়ালে টাঙানো সন্তানদের ছবির দিকে। তারপর আপনা থেকেই বলতে থাকেন,‘২০১০ সালে আমার বড়ছেলে অহি-কে নিয়ে কুড়াউড়া নবীনচন্দ্র হাই স্কুলেমাঠে বৈশাখি মেলা দেখতে গিয়েছিলাম। ছেলেকে আইসক্রিম কিনে দেবার পর একটু গলা আইসক্রিম আমার প্যান্টে পড়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে সেই আইসক্রিম পড়া জায়গাটা আমার ছেলে টিস্যু দিয়ে মুছে দিয়েছিল। এটিই আমার জীবনের উজ্জ্বলতম স্মৃতি, সবচে’আনন্দের স্মৃতি!’ মাহমুদুর রহমান জগলু’র ভাইপো রুবেল বলেন, চাচা সারাজীবন শুধু ঠকেই গেলেন। কিন্তু নিজে কাউকে ঠকাননি। ২০০২ সালে বিয়ে করে চাচীকে এসএসসি পাশ করিয়ে ক্রমান্বয়ে মাস্টার্স পর্যন্ত পাশ করিয়েছেন। অবশেষে সেই চাচীও তার অসুস্থতার পর তার সঙ্গে চরম প্রতারণা করলেন। এই হলো আমাদের প্রিয় জগলু চাচা---একা ও প্রতারিত। বাংলাদেশ সময়: ১৭৪0 এএম ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৭ বিবিবি/জেএম