হেমন্ত আসে চুপি চুপি। ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ বলে কোনও কবি খবর জানান নি হেমন্তের।
বাংলাদেশে এখন ছয়টি ঋতুর পরিপূর্ণ দেখা পাওয়া দুর্লভ হয়ে গেছে। প্রলম্বিত গরম ও বর্ষাই মূলত ছেয়ে থাকে জীবনের সবটুকু। বছরের শেষে দিয়ে যায় খানিকটা শীতের পরশ। বাকী ঋতুগুলো প্রকৃতিতে নয়, অনাদরে মুখ গুজে পড়ে থাকে ক্যালেন্ডারের ধূসর পাতায়। গ্রীষ্ম, বর্ষা এবং কিছুটা শীত ছাড়া শরৎ, হেমন্ত আর বসন্তকে চরমভাবে পাওয়া যায় না পরিবর্তমান বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশে।
প্রকৃতির মতো সাহিত্যেও অনাদৃত হেমন্ত। যদিও বাংলা ভাষার কবি ও সাহিত্যিকরা ঋতু আর প্রকৃতি বন্দনায় সিদ্ধহস্ত, তথাপি হেমন্ত নিয়ে নেই তেমন কোনও কাব্যিক বহিঃপ্রকাশ। ব্যতিক্রম জীবনানন্দ দাশ। তিনি হেমন্তকে নানাভাবে দেখেছেন। ব্যবহার করেছেন তাঁর এমন কবিতায় অনেক শব্দ, যা হেমন্তের সমার্থক। জীবনানন্দকে বলাও হয় ‘ধূসর ঋতু হেমন্তের কবি’। তাঁর আরেকটি পরিচিতি হলো ‘নির্জনতম কবি’। বলেছেন, ‘যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে/পথের পাতার মতো তুমিও তখন/আমার বুকের ‘পরে শুয়ে রবে। ’ জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় ‘নবান্ন’, ইদুঁর’, ‘শালিক’, ‘লক্ষ্মীপেঁচা’, ‘নির্জন স্বাক্ষর’, কার্তিকের নীল কুয়াশায়’ ইত্যাদি শব্দ ও উপমা এমন যুৎসইভাবে প্রয়োগ করেছেন যে, তাঁর কবিতা পাঠে হেমন্তের সমগ্র আবহ মানসপটে চলে আসে। কবি নিজেও ভারাক্রান্ত আবেগে উচ্চারণ করেছেন, ‘যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়/যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে-ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে/যখন চড়াই পাখি কাঁঠালীচাপাঁর নীড়ে ঠোটঁ আছে গুজে/যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে খয়েরী পাতায়/যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়/শামুক গুগলিগুলো পড়ে আছে শ্যাওলার মলিন সবুজে-। ’
হেমন্তের সঙ্গে আরো অনেক উপমার সারিতে বিশেষ ও অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে আছে নতুন ধানের উৎসব ‘নবান্ন’। মাঠ ভর্তি ধানের পাশাপাশি গাছ ভর্তি হয়ে থাকে চালতা আর কামরাঙা। নারকেলও প্রচুর পাওয়া যায়। নতুন ধানের চাল দিয়ে নারকেল সহযোগে নানা পিঠা, পুলি হেমন্তের অনুসঙ্গ, যা শীতেও বহাল থাকে।
শিউলি, কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকা, দেবকাঞ্চন, হিমঝুরি, ধারমার, রাজঅশোক ফুল পূর্ণতায় ভরিয়ে দেয় প্রকৃতি ও পরিবেশ। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় পাখির কল-কাকলি আর ফুলের সৌরভে মাতোয়ারা হৈমন্তি দিনগুলো চিরায়ত বাংলার রূপ, রস ও সৌরভ সঞ্চিত সম্পদ।
গ্রাম-বাংলায় হেমন্ত নিয়ে এসেছে জীবনের উল্লাস। মাঠে মাঠে ফসলের সমারোহ। ধান কাটার আয়োজন।
নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে জীবন জেগে উঠে কার্তিকে, এবং তারপর অগ্রহায়ণে, হেমন্তে। শুরু হয় আত্মীয় বাড়ি বেড়ানোর পালা। মেয়ে, বৌদের ‘নাইয়ব’ যাওয়ার ধুম লাগে এ সময়ে। মেলা, পার্বণ, উৎসবে ছেয়ে যায় চিরায়ত গ্রাম-বাংলা। শাশ্বত গ্রামীণ ঐতিহ্যও তখন নবপ্রাণ পায়। পিঠা, পুলির সঙ্গে নানা ধরনের গ্রামীণ খাদ্য ও সামগ্রী, কুটির শিল্পজাত দ্রব্যাদিতে ভরপুর হয়ে যায় গ্রাম্য মেলা আর হাট-বাজারগুলো। মাছ ধরার আয়োজনও চলে তখন। গ্রীষ্মের খরতাপ আর শীতের তীব্রতাহীন জীবন-যাপন মোহনীয় আলো-ছায়ার মায়ায়-মায়ায় বয়ে চলে যায় অমরাবতীর অমৃতলোকে।
শরতের শিশির বিন্দুগুলো হেমন্তে এসে যৌবন লাভ করেছে। কুয়াশার হাল্কা বুনন ভারী হয়েছে এই ঋতুতে। আজ কার্তিকের নতুন হৈমন্তি সকালে মনে হচ্ছে, ভোরগুলো ভেসে এসেছে অনেক অনেক দূর থেকে, শিশির মেখে, কুয়াশা চাদর জড়িয়ে। তাপহীন মায়াবী আলোর ভোর স্বাগত জানাচ্ছে প্রতিটি নতুন দিনকে।
সন্ধ্যাগুলো খুব তাড়াতাড়ি চলে যেতে চাইছে রাতের কোলে। দিন ও রাত্রির প্রহরে প্রহরে হেমন্ত এঁকে দিচ্ছে প্রকৃতির নিজস্ব বৈভব ও স্বাতন্ত্র্য। মখমল মসৃণ হাওয়ার স্বিগ্ধতায় জুড়িয়ে দিচ্ছে সকলের মন-প্রাণ। প্রকৃতি বড় বেশি মায়াবী রূপ লাভ করেছে হেমন্তে। গ্রীষ্মের রূঢ়তা নেই, নেই শীতের আড়ষ্ঠতা, মাঝামাঝি এক অনির্বচনী পুলক স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে মানুষের দেহে ও চৈতন্যে। জাগাচ্ছে স্বর্গীয় অনুভূতি।
যান্ত্রিক নগর-জীবনের অন্তঃহীন দুর্ভোগের নৈমিত্তিক অভিজ্ঞতা শেষে ক্ষুদ্র-বদ্ধ প্রকোষ্ঠের বন্দি প্রাত্যহিকতায় হেমন্তের সুধারস কি করে পান করা যাবে? অথচ চারপাশে বয়ে যাচ্ছে জীবনের আনন্দধ্বনি ও মঙ্গলালোক।
প্রতিটি দিন, প্রতিটি মাস, প্রতিটি ঋতু নব-নব পত্র-পুষ্প-পত্রালী সাজিয়ে প্রকৃতির বরণ-ডালায় ডাকছে আমাদের। সুন্দর বেঁচে থাকার জন্য সেখানে যে আমাদের যেতেই হবে।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-কথাশিল্পী-গবেষক। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৭
এমপি/জেডএম