ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

চাকরি ছেড়ে দেশি মুরগির খামার, মাসে আয় লাখ টাকা 

সুজন বর্মণ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০২২
চাকরি ছেড়ে দেশি মুরগির খামার, মাসে আয় লাখ টাকা 

নরসিংদী: প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ শেষ করে চাকরিতে যোগদান করেছিলেন নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার তারেক জামান। কাজ করেছেন দেশের নামকরা কয়েকটি গার্মেন্টসে।

 

কিন্তু সব সময় নিজেই উদ্যোক্তা হতে চাইতেন তিনি। সেই ইচ্ছা থেকেই তিনি ৪৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে দেশি মুরগির খামার করার পরিকল্পনা নেন। প্রথমে ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু করে সফলতা পান তিনি। এরপর তিনি ৪০ লাখ টাকা খরচ করে দোতলা খামার করেছেন। দেশি মুরগির খামারের নাম রেখেছেন টিএম অ্যাগ্রো ফার্ম।  এ খামার থেকে মাসে আয় করছেন লক্ষাধিক টাকা, ভবিষ্যতে বছরে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন ৫০ লাখ টাকা।

তারেক জামান শিবপুর উপজেলার সাধারচর ইউনিয়নের মাধবদী গ্রামের বাসিন্দা।

আগে গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরেই দেশি মুরগি পালন করা হতো। প্রতিটি ঘরেই কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয়টি দেশি মুরগি থাকতো। বাড়িতে মেহমান এলে, নিজেদের পোষা মুরগি রান্না করে খাওয়ানো হতো। যার স্বাদ ছিল অনন্য। বর্তমানে ব্রয়লার আর সোনালি-পাকিস্তানি মুরগিতে বাজার সয়লাব খাকলেও মানুষ দেশি মুরগি খোঁজে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় দেশি মুরগির সরবরাহ কম। যাও পাওয়া যায়, ক্রেতারা একটু বেখেয়াল হলেই পাকিস্তানি বা সোনালি মুরগিকে দেশি বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।

খামার সূত্রে জানা যায়, চাহিদার কথা চিন্তা করে গুণগত মানের দেশি মুরগি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে তারেক জামান ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে চাকরি ছেড়ে অর্গানিক টিএম অ্যাগ্রো ফার্ম গড়ে তোলেন। বাড়ির পাশেই পারিবারিক তিন বিঘা জমিতে ৫০০ মুরগি নিয়ে খামারের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে তিনি নিজেই খামার দেখাশোনা করতেন। পরে তিনজন শ্রমিক নিয়োগ দেন। খামারের মুরগির খাবারে কোনো কেমিক্যাল ফিড ব্যবহার করেন না তিনি। অর্গানিক খাবার যেমন ধান, গম, ভূট্টা, কুড়া, খুদ, ঘাস খাওয়ান। যার কারণে মুরগির মাংসে কোনো ক্ষতিকর উপাদান থাকে না। আর ব্রয়লার মুরগির তুলনায় দেশি মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। যার ফলে মুরগি রোগে আক্রান্ত হলেও সময় মতো ভ্যাকসিন দেওয়া হলে রোগ ভালো হয়ে যায়।  

শুরুতেই তারেকের দেশি মুরগির খামারের কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় তার খামার থেকেই এলাকার মানুষ ও পাইকাররা এসে মুরগি কিনে নিতেন। ফলে ভালোই লাভ হয়। চাহিদা বাড়ায় একটা পর্যায়ে খামার বড় করার উদ্যোগ নেন তিনি। সে ভাবনা থেকেই ২০২১ সালের কোরবানি ঈদের পরে প্রায় ৪০ লাখ টাকা খরচ করে তিন বিঘা জমিতে আধুনিক দোতলা ঘর বানিয়ে তাতে মুরগির খামার করেন। যেখানে একসঙ্গে ১৫ হাজার মুরগি পালন করা যাবে। বর্তমানে তার খামারে প্রায় পাঁচ হাজার মুরগি রয়েছে। তিনি একসঙ্গে ১৪ ব্যাচ মুরগি পালন করতে পারেন।

খামারটি ঘুরে দেখা যায়, খামারের চারপাশে জাল দিয়ে বেড়া দেওয়া। খামারের উঠানে খোলা পরিবেশে ঘুরে ঘুরে খাবার খাচ্চে মুরগিগুলো। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই দোতলায় অফিস রুম। পাশে রয়েছে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর অটো ইনকিউবেটর মেশিন। যেখানে ১৮ দিন নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখার পর ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে। তারেক জামান পুরো খামারটিতে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির সমাহার ঘটিয়েছেন। তিনি মুরগির বাচ্চাগুলোকে বয়স (একদিন থেকে ১২০ দিন বয়সী) অনুযায়ী ভাগ করে আটটি আলাদা জোনে (স্থানে) রাখেন। এক নম্বর জোনে একদিনের বাচ্চা, দুই নম্বর জোনে ১৫ দিনের বাচ্চা, তিন নম্বর জোনে ৩০ দিন, চার নম্বর জোনে ৪৫ দিন, পাঁচ নম্বর জোনে ৬০ দিন, ছয় নম্বর জোনে ৭৫ দিন, সাত নম্বর জোনে ৯০ দিন ও আট নম্বর জোনে ১২০ দিনের মুরগি থাকে। ফলে তিনি সহজেই মুরগিগুলোর যত্ন নিতে পারেন। এছাড়া কেউ এক বা ৩০ দিনের বাচ্চা চাইলে তিনি কম সময়েই জোন থেকে বের করে দিতে পারেন। আর খামারের নিচতলায় রয়েছে বিশাল গুদাম ঘর। যেখানে বস্তায় ভরে থরে থরে সাজানো রয়েছে নানা অর্গানিক খাদ্য। এর পাশেই রয়েছে ডিম পাড়া মুরগির জোন। এখানে মুরগিগুলোর ডিম পাড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। মুরগির বয়স সাড়ে তিন মাস হলেই বাজারে বিক্রি করা হয়। একেকটি মুরগির ওজন হয় ৯০০ গ্রাম থেকে এক কেজি।

তারেক নিজেই মুরগি বাজারজাত করেন। তিনি খামার থেকেই ডিমসহ বয়স অনুযায়ী ১০ ধরনের মুরগি বিক্রি করছেন। খামার থেকেই পাইকারি ক্রেতারা মুরগি কিনে নিয়ে গেলেও তিনি নিজে হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা চালু করেছেন। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীর ক্রেতাকে লক্ষ্য করে হোম ডেলিভারি দিচ্ছেন তিনি। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অর্ডার নিয়ে তিনি সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে তা পৌঁছে দিচ্ছেন ক্রেতাদের দুয়ারে। প্রতি কেজি মুরগি বিক্রি করছেন ৪০০ টাকায়। এছাড়া তারেকের মুরগি ঢাকার নামকরা সুপারশপসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে।

খামারের মুরগির খাবার দিচ্ছিলেন শ্রমিক সোহেল মিয়া। তিনি  বলেন, ব্রয়লার মুরগির তুলনায় দেশি মুরগির যত্ন কম নিতে হয়। আমরা শুধু সময় মতো খাবার দিই। মুরগি বাইরে ঘুরে ঘুরেই খাবার খায়। আর কোনো রোগ হলে টিকা দেওয়া হয়।

আরেক শ্রমিক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ব্রয়লার মুরগির তুলনায় দেশি মুরগির মাংস খেতে খুবই সুস্বাদু।

তারেকের দেশি মুরগির খামারের সাফল্য দেখে এলাকার অনেকেই খামারের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দা মেহেদী হাসান নাহিদ বাংলানিউজকে বলেন, মানুষ মুরগির খামার মানেই ব্রয়লার মুরগির খামার ভাবত। কিন্তু তারেক ভাই সবার চিন্তা ভাবনা বদলে দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, সঠিকভাবে খামার পরিচালনা করলে দেশি মুরগি দিয়েও লাভবান হওয়া যায়। এখন ভাইয়ের পরামর্শ নিয়ে এলাকার অনেকেই ক্ষুদ্র পরিসরে দেশি মুরগি পুষতে শুরু করেছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারেক জামানের দেশি মুরগির সফলতার ভিডিও দেখে ঢাকার বিমানবন্দর এলাকা থেকে খামারে এসেছেন অমিত হাসান। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, তারেক ভাইয়ের খামারের ভিডিও দেখে আমি দেশি মুরগির খামার করতে চাচ্ছি। মুরগির খামার এতো টাকা ব্যয় করে করা হয়, তা আগে কখনও ভাবিনি। তাই সরাসরি খামারটা দেখে ও ভাইয়ের পরামর্শ নিয়ে ভবিষ্যতে আমিও খামার করবো। এ কারণেই বন্ধুকে নিয়ে খামার দেখতে চলে এলাম।

টিএম অ্যাগ্রো ফার্মের মালিক তারেক জামান বাংলানিউজকে বলেন, অর্গানিক খাবার আমি নিজে খাবো ও মানুষের কাছে পৌঁছে দেব- এ উদ্দেশ্য নিয়েই আমি দেশি মুরগির খামার গড়ে তুলেছি। মুরগিগুলো পুরো অর্গানিক খাবার খেয়ে খোলামেলা পরিবেশে বড় হয়। ফলে মাংসের স্বাদ ঠিক থাকে। দেশে দেশি মুরগির বিপুল চাহিদা রয়েছে। শুধু ঢাকা শহরেই প্রতিদিন এক কোটি মুরগির চাহিদা রয়েছে। মূলত আমি এ বাজারকেই লক্ষ্য করে ৪০ লাখ টাকায় দেশের সবচেয়ে বড় ও আধুনিক খামার গড়ে তুলেছি। এখন পাঁচ হাজার মুরগি পালনে মাসে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা খরচ শেষে লাখ টাকা লাভ হচ্ছে। ১৫ হাজার মুরগি একসঙ্গে পালন শুরু হলে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকা আয় হবে। এছাড়া ভাবষ্যতে দেশি মুরগির পাশাপাশি হাঁস, ছাগল, কবুতর ও গরুর খামার করার পরিকল্পনা রয়েছে।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের লাইভস্টক অফিসার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল শামীম বাংলানিউজকে বলেন, ব্রয়লার মুরগির তুলনায় দেশি মুরগির বৃদ্ধিটা সময়সাপেক্ষ। তাই খামারিরা দেশি মুরগির প্রতি কম আগ্রহ দেখায়। তবে ব্রয়লার মুরগির তুলনায় দেশি মুরগি পালন কম ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিশ্রম কম লাগে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকার কারণে সময়মতো টিকা দিলেই হয়। আর বাজারে চাহিদা বেশি থাকায় দেশি মুরগি পালনে লাভও বেশি। দেশি মুরগির খামারিদের আমরা বিভিন্ন পরামর্শের মাধ্যমে সহযোগিতা করে থাকি। মাঝে মধ্যে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়। তারেক জামান খুব বড় পরিসরে দেশি মুরগির খামার করেছেন। আমরা তাকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।