ফজলুল হক সৈকত || ২০১৬ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ বই ‘আমাদের বাঁচার দাবী’ : ৬ দফা’র ৫০ বছর। বইটির লেখক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ এবং দেশবরেণ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. হারুন-অর-রশিদ।
মূলত নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল গবেষক ড. হারুন-অর-রশিদ সবসময় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসকে চেতনায় ধারণ করেন বলেই এমনটি সম্ভব হয়েছে। বিষয় এবং সময়ের বিবেচনায় অত্যন্ত তাৎপর্যবহ বই এটি। ৬ দফার অর্ধশতবার্ষিকীতে দেশবাসীর জন্য লেখকের এক বিশেষ উপহার। তিনি সঠিক সময়ে সঠিক কাজটিই করেছেন। লেখকের অপরিসীম ধৈর্য ও আনন্দের ফসল এই বই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ১ দিনের চিন্তা বা ৯ মাসের যুদ্ধের ঘটনামাত্র নয়—এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বাঙালির রাজনৈতিক-সাহিত্যিক-ঐতিহাসিক বিবর্তন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ৬ দফার প্রেক্ষাপট ও সময় শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শিতার ফসল। ৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরের বছর—১৯৬৬ সালে ৬ দফা প্রণয়ন কোনো সাধারণ ব্যাপার ছিল না। পূর্ব-পাকিস্তানের অর্থনীতি এবং নিজস্ব নিরাপত্তা বিষয়ে সতর্ক মুজিবের ৬ দফা খুব স্বাভাবিকভাবেই বাঙালির বাঁচার দাবিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ৬ দফা ঐতিহাসিক ঘটনা এই কারণে যে, তা বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। মাত্র ৪-৫ বছরের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ জনতার বাঁচার দাবিই ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত গড়িয়েছে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কঠোরভাবে প্রচারমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করছিল। এবং ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ছিল সরকারের বিরুদ্ধে বিরাট জবাব।
৬ দফার মূলকথা—১৯৭০ সালের নির্বাচনের ক্যাম্পেইনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রবাহকে আন্দোলনের দিকে ধাবিত করা। গ্রামে গ্রামে তখন ৬ দফার কর্মসূচি প্রচারিত হলো। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই ৬ দফা। ১৯ এপ্রিল দৈনিক ইত্তেফাক লাহোর প্রস্তাবের ২৬তম বার্ষিকীতে যে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে, তাতে ৬ দফার লোগো ছাপানো হয়—লাল রঙের একটি বৃত্তের পাশে সবুজ রঙের চৌকোণো ছক। লাল-সবুজ-কালোতে লেখা—৬ দফা আমাদের বাঁচার দাবি। ভবিষ্যৎ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের পতাকার রঙ যে তখনকার রাজনীতিবিদ ও চিত্রশিল্পীদের মনে আঁকা হয়ে গিয়েছিল, তা সত্যিই বিস্ময়কর।
‘আমাদের বাঁচার দাবী’ : ৬ দফা’র ৫০ বছর একটি অবশ্যপাঠ্য বই। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের নতুন নতুন দরোজা খুলে দেবে এই বই। অধ্যাপক ড. হারুন তাঁর বইয়ে ইতিহাসের ধারাক্রম অনুযায়ী অধ্যায়-বিভাজন করেছেন। প্রয়োজনীয় তথ্যপঞ্জি ব্যবহার করে গবেষণার মান সমুন্নত রেখেছেন। বইটিতে সন্নিবেশিত হয়েছে ছয়টি অধ্যায়। ৬-দফার সাথে ৬-অধ্যায়ও নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। অধ্যায়গুলো যথাক্রমে : ‘অসাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আওয়ামী লীগ’, ‘আইয়ুব শাসন আমল (১৯৫৮-১৯৬৯) : বাঙালির স্বাধীনতা ভাবনা’, ‘৬-দফার ৫০ বছর : পরিপ্রেক্ষিত ও তাৎপর্য’, ‘৬৬ থেকে ৭১’, ‘বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়’ এবং ‘ঐ মহামানব আসে’। পরিশিষ্টে যুক্ত হয়েছে—১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপিত ৬-দফা কর্মসূচি, সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর নীতি-নির্ধারণী বক্তৃতা, ২০ মার্চ ১৯৬৬ পল্টন ময়দানে জনসভায় মুজিবের ভাষণ, ৬-দফা দাবির প্রতি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের প্রতিক্রিয়া এবং প্রাসঙ্গিক দুর্লভ ২৭টি আলোকচিত্র। আলোকচিত্রগুলো বইটির মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও কর্মসূচি অনুধাবন করতে এইসব আলোকচিত্র বিশেষভাবে সহায়ক।
বইটির ‘প্রাক্কথা’য় লেখক জানাচ্ছেন : ‘১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের কোথাও “পাকিস্তান” শব্দটি ছিল না, কিন্তু ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায়। অপরদিকে, ১৯৬৬ সালের ৬-দফা কর্মসুচিতে কোথাও সরাসরি বাঙালির স্বাধীনতা বা তাদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়নি। তবে ৬-দফাকেন্দ্রিক আন্দোলনের পথ ধরেই পরিশেষে ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর ৬-দফা কর্মসূচি পেশের মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই ঘটে বাংলাদেশ বিপ্লব, ১৯৭১। কী করে সেটি সম্ভব হলো? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য যা জানা আবশ্যক তা হচ্ছে, ৬-দফা কোনো দলের রাজনৈতিক ‘দরকষাকষি’র বা গতানুগতিক রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। এর মর্মমূলে ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীন রাষ্ট্রিক ধারণা—যা বঙ্গবন্ধু অনেকদিন থেকেই লালন করে আসছিলেন। ’
৬ দফার আড়ালে ছিল পূর্ব-পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি রূপরেখা। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা স্বাধীনতার মূল ভিত্তি হিসেবে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। বাঙালির ইতিহাসে হাজার বছরের একটি টার্নিং পয়েন্ট হলো ১৯৬৬ সালের ৬ দফা। আর তার অন্তরালে ছিল মূলত বঙ্গবন্ধুর ১ দফা—আমাদের স্বাধীনতার কথা। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে থেকে ৬ দফার ভিত্তিতে বাঙালির ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায় কিছুতেই শেখ মুজিবের লক্ষ্য ছিল না, সম্ভবও ছিল না। তাঁর লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জন। উল্লেখ্য, ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব-পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘৬ দফা দাবী’ পেশ করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা উত্থাপন করা হয় লাহোর প্রস্তাবের সাথে মিল রেখে ২৩ মার্চ। বর্তমান বইটি পাঠককে ইতিহাসের বিশেষ এক বাঁক সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার পাশাপাশি পৌঁছে দেবে নতুন নতুন তথ্য ও চিন্তার দোরগোড়ায়।
............
‘আমাদের বাঁচার দাবী’ : ৬ দফা’র ৫০ বছর
হারুন-অর-রশিদ
প্রকাশক : বাংলা একাডেমি, ঢাকা
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১৬
কর্মসূচি পরিচালক : মোবারক হোসেন
প্রচ্ছদ : ১৯৬৬ সালে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনসম্মুখে ৬ দফা ঘোষণার সময় সভামঞ্চ , পুস্তিকার প্রচ্ছদ ও লোগো হিসেবে ব্যবহৃত নকশা- শিল্পী : হাশেম খান
মূল্য : ২০০ টাকা
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৮ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০১৬
টিকে/