যারা বাইক চালান অথবা যারা গাড়ি নিয়ে ছুটির দিনে পরিবার নিয়ে ঘুরতে বের হন, তারা মাঝে মাঝে কোথায় যাবেন সেরকম জায়গা নির্ধারণ করতে হিমশিম খান। কারণ সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলো হয়ত আপনার শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে।
এমনই এক জায়গা রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য। জায়গাটার সন্ধান দেন আমাদের শুভ্র সেন। যিনি কিনা একটু ফাঁক-ফোঁকর পেলেই বাইক নিয়ে চলে যান যেখানে সেখানে।
যাই হোক এক ছুটির দিনে আমি, শুভ্র সেন আর অ্যাড ফিল্ম মেকার আর. ডি. অমিয় রওনা হই রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যের উদ্দেশে। সঙ্গী অবশ্যই আমাদের তিন বাইক।
হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য। এটি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার খুব কাছে এবং ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত সংলগ্ন।
রাজধানী ঢাকা থেকে সড়র পথে এর দূরত্ব মাত্র ১৩০ কিলোমিটার। হবিগঞ্জ জেলায় বনবিভাগের কালেঙ্গা রেঞ্জের তিনটি বিট- কালেঙ্গা, রেমা আর ছনবাড়ি নিয়ে এই অভয়ারণ্যের সীমানা।
রেমা-কালেঙ্গা বাংলাদেশের একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বন এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বণ্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। জীব ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এ বনাঞ্চলটি শুকনো ও চিরহরিৎ।
১৯৮২ সালে বনভূমিটিকে রেমা–কালেঙ্গা অভয়ারণ্য নামে ঘোষণা করা হয় এবং পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে এটিকে আরও সম্প্রসারণ করা হয়। বর্তমানে (২০০৯) এই অভয়ারণ্যের আয়তন ১৭৯৫.৫৪ হেক্টর। বাংলাদেশের যে কয়েকটি প্রাকৃতিক বনভূমি এখনো মোটামু্টি ভাল অবস্থায় টিকে আছে, রেমা-কালেঙ্গা তার অন্যতম।
এখানে যাওয়ার সময় রাইডাররা প্রথমে বাংলাদেশের সবচাইতে সেফ হাইওয়ে (আমার মতে) সিলেট হাইওয়ে পাবেন। তারপর চা বাগানের ভেতর দিয়ে আঁকা-বাঁকা রেসিং ট্র্যাক, সাপের মতো আঁকা-বাঁকা রাস্তা, আর সব শেষে চার কিলোমিটারের মতো মাটির রাস্তা পাবেন। মাটির রাস্তার দুই পাশে ধানক্ষেত আর তাল গাছে বাবুই পাখির বাসা রাস্তাটার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে। আর রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যের ভেতর বনের মাঝে কমান্ডো থ্রিল রাস্তা তো থাকছেই।
রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য বিরল প্রজাতির জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। বর্তমানে এই বনে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, সাত প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা-লতাগুল্ম পাওয়া যায়। বিভিন্ন বিরল প্রজাতির পাখির জন্য এই বন সুপরিচিত এবং এদের মধ্যে রয়েছে-ভীমরাজ, টিয়া, হিল ময়না, লাল মাথা কুচকুচি, সিপাহি বুলবুল, বসন্তবৌরী, শকুন, মথুরা, বনমোরগ, পেঁচা, মাছরাঙা, ঈগল, চিল প্রভৃতি।
এখানে একটি সুন্দর ‘ওয়াচ টাওয়ার’ রয়েছে, যেখান থেকে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত দেখা যায়। প্রচণ্ড গরমেও মৃদু কিংবা দমকা হাওয়া আপনার শরীরে শীতল পরশ বুলিয়ে দেবে। ভাবছি একবার ভরা পূর্ণিমায় অবশ্যই এ বনে যাবো। সুন্দরবনে পূর্ণিমা দেখার জন্য অনেক প্ল্যান আর খরচের প্রয়োজন। সেই সঙ্গে আবার জলদস্যুর ভয়। একটা বিষয় বলে রাখা ভালো, এই রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যের ভেতরে ওয়াচ টাওয়ারের সামান্য দূরে একটা বিজিবি ক্যাম্প রয়েছে।
এই বনে তিন প্রজাতির বানরের বাস। এগুলো হলো-কুলু, রেসাস ও নিশাচর লজ্জাবতী বানর। তাছাড়া পাঁচ প্রজাতির কাঠবিড়ালির দেখা মেলে এখানে। এর মধ্যে বিরল প্রজাতির মালয়ান বড় কাঠবিড়ালি একমাত্র এ বনেই পাওয়া যায়।
বন্যপ্রাণীর মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য আরও রয়েছে মুখপোড়া হনুমান, চশমা হনুমান, উল্লুক, মায়া হরিণ, মেছোবাঘ, বন্যশুকর, গন্ধগোকুল, বেজি, সজারু ইত্যাদি। কোবরা, দুধরাজ, দাঁড়াশ, লাউডগা প্রভৃতিসহ এ বনে ১৮ প্রজাতির সাপের দেখা পাওয়া যায়।
এখানে কিন্তু এক কিলোমিটারের একটা লেকও আছে। আমাদের গাইডের কথা অনুযায়ী ভীষণ বড় বড় মাছ পাওয়া যায় এখানে। যদি কারও মাছ ধরার নেশা থাকে, তবে চাইলে ছিপ নিয়ে আসতে পারেন ।
যা হোক এবার আমাদের ভ্রমণের কথায় আসা যাক। ঢাকা থেকে সকাল সাড়ে ৬টায় রওয়ানা দিয়ে সিলেট হাইওয়ে ধরে ৮টায় পৌঁছলাম ভৈরব। সেখানে ভরপেট নাস্তা করলাম উজান ভাটি হোটেলে। এরপর মাধবপুর বাজার, পুরাতন সিলেট মহাসড়ক ধরে সাড়ে ৯টার দিকে পৌঁছলাম সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে। এটি বাংলাদেশের আর একটি প্রাকৃতিক উদ্যান।
ওখানে কিছু সময় কাটিয়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গেলাম রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে।
এরপর লাঞ্চ করতে গেলাম চা বাগানের ১২৩ বছরের পুরোনো এক বাংলোতে। ১৮৯০ সালে এই বাংলো তৈরি করেছিলো ইংরেজরা।
এতো পুরনো অথচ ছবির মতো সুন্দর এ বাংলো দেখে তো আমাদের চোখ ছানাবড়া। এরপর বিকেল ৩টায় টাটকা চা পান করে রওয়ানা দিলাম ঢাকার দিকে। আসতে সময় লাগলো মোটামুটি চার ঘণ্টা।
কিভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন:
ঢাকা থেকে সিলেটের রাস্তা ধরে গেলে ভৈরব পার হওয়ার পর মাধবপুর বাজার পাবেন। মাধবপুর গোল চত্বরে ( তিন রাস্তার মোড়) গিয়ে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে আপনাকে পুরাতন সিলেট হাইওয়ের পথ বলে দেবে। পুরাতন সিলেট হাইওয়ে দিয়ে সাতছড়ি পাড় হয়ে সোজা চুনারু ঘাট যেতে হবে। চুনারুঘাট থেকে ডান দিকে মোড় নিলেই রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য যাওয়ার রাস্তা।
আর একটা কথা বলতে ভুলে গেছি রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যতে যাওয়ার পথে যখন মাটির রাস্তা শুরু হবে তখন ডান দিকে চোখ রাখতে ভুলবেন না। কারণ ছোট্ট সুন্দর একটা নদী রয়েছে এই পথে।
অনেকেই হয়তো মনে মনে ভাবছেন, এতো যে কথা কিন্তু ওখানে গিয়ে থাকবো কোথায়, আর খাবই বা কি।
আপনারা যদি রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যের বাংলোতে থাকতে চান তবে সিলেটের বন বিভাগ থেকে পারমিশন নিয়ে যেতে হবে। তবে সেখানে পানির একটু সমস্যা আছে। পানির লেয়ার অনেক গভীরে থাকায় বাংলোতে পানির ব্যবস্থা নেই। নিচ থেকে আনতে হয়।
তবে ওখানকার কিছু লোকাল লোক আছে যারা আপনার থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবে। এটা তেমন কিছু নয়, তবে আপনার থাকা খাওয়া বেশ ভালই হবে আশা করা যায়।
এখানে এক হাজার থেকে ১৫শ’ টাকার ভেতর একটা ভাল রুম পেয়ে যাবেন, যাতে অনায়াসে তিন চারজন থাকতে পারবেন। তবে মশার উৎপাত থেকে বাঁচতে হলে মশার কয়েল নিতে একদমই ভুলবেন না।
সবচেয়ে ভাল হয় যদি আপনি আগে থেকেই কোনো গাইডকে ফোন করে আপনার সেখানে যাওয়ার বিষয়টি তাকে জানিয়ে দেন। তাহলে আপনি অন্তত থাকা খাওয়ার বিষয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। বিকাশ করে তাকে কিছু টাকাও পাঠাতে পারেন অগ্রিম হিসেবে। এমন একজন গাইড স্বপন (ফোন-০১৭৫৬৯১৪৪৬০)।
তবে শ্রীমঙ্গলে অনেক ভালো থাকার জায়গা আছে সেটা রেমা-কালেঙ্গা থেকে মাত্র ত্রিশ/চল্লিশ কিলোমিটারের পথ।
ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে। আর মাস শেষে ‘ট্রাভেলার্স নোটবুক’র সেরা লেখকের জন্য তো থাকছেই বিশেষ আকর্ষণ..
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেন।
আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- bntravellers.notebook@gmail.com এই ঠিকানায়
লেখক: মো. সাদিকুল্লাহ জুন
ফিল্যান্স ফটোগ্রাফার
shadiq.bfhl@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০১৪
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর