ফুকেট (থাইল্যান্ড) থেকে ফিরে: ব্যাংককের সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টে নেমে থালংগর পথে যাত্রা শুরু করতে সময় নেইনি। থালংগ স্থানীয় নাম, সবাই চেনে ফুকেট নামে।
ব্যাংকক থেকে ফুকেট যেতে উড়োজাহাজ কিংবা বাস যে কোনো বাহনই পছন্দ হতে পারে। ভ্রমণপিয়াসীদের জানিয়ে রাখি- ব্যাংকক থেকে মাত্র দেড় ঘণ্টায় ফুকেটে উড়ে যেতে পকেট থেকে দেড় হাজার বাথ (১ বাথ = ২.৭০ টাকা) খসে যাবে। বাংলাদেশের হিসেবে চার হাজার টাকা। (তবে বাংলাদেশি টাকা ভাঙানোর সুযোগ নেই এখানে, বাংলাদেশ থেকে ডলার কিনে সেই ডলার বিক্রি করেই বাথ কিনতে হবে। ) আর খরচ কম করতে চাইলে মাত্র সাড়ে পাঁচশ’ বাথে বাসে চেপে বসতে হবে। এতে সময় লাগে ১৩ ঘণ্টা। ভ্রমণে যাদের ক্লান্তি নেই তাদের জন্য এই বাসই প্রিয়।
বাসেই কম খরচ, রাতে বাসযাত্রা তাই এক রাতের হোটেল খরচও বেঁচে যাবে এই হিসাব কষে আমারও প্রিয় বাহন বাস। আর সমুদের বুক চিড়ে ছুটে যাওয়া সেতু ধরে ফুকেটে যাওয়ার আনন্দটিও কম কথা নয়।
বাসে উঠে অবাকই হলাম। দোতলা বাসের দ্বিতীয় তলায় সিট। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই দেখি এলইডি লাইট দিয়ে সাজানো বাসের কমপার্টমেন্ট। উড়োজাহাজের কেবিন ক্রুর মতই স্যুট-টাইপরা বাসের কন্ডাক্টর বিস্কুট, পানি আর কম্বল নিয়ে হাজির।
সময় সকাল ৯টা। দীর্ঘ ১৩ ঘণ্টার যাত্রা শেষে বাস এসে থামল থাইল্যান্ডের সবচেয়ে প্রাণবন্ত দ্বীপ ফুকেটের বাস স্টেশনের টার্মিনাল-২ এ।
উঁচু-নিচু রাস্তা দেখে বোঝাই যায় যে এগুলো পাহাড় কেটে তৈরি। থাইল্যান্ডের এটিই সবচেয়ে বড় দ্বীপ। আয়তনে সিঙ্গাপুরের প্রায় সমান। জনসংখ্যা মাত্র ৬ লাখ।
মনে পড়ে যায় সেই ভয়াবহ সুনামির কথা। সাজানো-গোছানো-প্রাণবন্ত এই দ্বীপকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে সুনামিতে লণ্ডভণ্ড হয়েছিল ফুকেট।
পাহাড়ের উপর দিয়ে উঁচু-নিচু রাস্তায় প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে চলে এলাম পাতং বিচের পাশেই গেস্ট হাউজে। ক্লান্তি ঝেড়ে চটজলদি তৈরি হয়ে নিলাম। এবার ফুকেট দেখার পালা।
রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দু’পাশের অপরূপ সৌন্দর্য মুগ্ধ করছিলো। এই সৌন্দর্য কৃত্রিম। ফুকেটে স্থানীয়দের খুব একটা চোখে পড়ে না। বেশিরভাগই বিদেশি পর্যটক।
রাস্তায় একটি বিশেষ দিক নজরে এলো। বাংলাদেশে জনপ্রিয় এফ প্রিমিও, এক্স করলা, জি করলা, এলিঅন, টয়োটা হাইব্রিড, মাজডা এক্সিলার মত গাড়িগুলো সেখানে ট্যাক্সি হিসেবে কিংবা ভাড়ায় চলছে।
টানা ১৫ মিনিট হেটেও বিচের দেখা পেলাম না। অথচ গেস্টহাউজ বুকিং করার সময়ে দেখেছিলাম সেখান থেকে বিচে হেঁটে যেতে তিন মিনিট লাগে। শিক্ষাটি ভালোই হলো। হোটেলের চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা যাবে না।
২০ মিনিট হেঁটে পৌঁছে গেলাম পাতং বিচে। কাঠপোড়া রোদে আমরা সেখানে দাঁড়াতে পারছিলাম না। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ বিদেশি-বিদেশিনীরা অপেক্ষাকৃত স্বল্প-বসনে বালুর ওপর শুয়ে সান-বাথ করছে।
সমুদ্রের পানির মূল মুগ্ধতা এর রঙে। নীল নাকি সবুজ- নিশ্চিত হতে পারলাম না। বিভিন্ন জনের চোখে ধরা দিচ্ছে বিভিন্নভাবে। তবে পানি এতই পরিষ্কার যে নিচের বালুকণা দেখা যাচ্ছিলো। ঢেউগুলো ছোট ছোট। দেখেই মুগ্ধ। এবেলা সমুদ্রে নামলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম হোটেল গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে রাতে বের হবো।
আগেই শুনেছিলাম ফুকেটে একটা বাংলা রোড আছে। রাতে প্রথমেই গন্তব্য সেই বাংলা রোড। ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা বন্ধ। আর গোটা রাস্তাই যেনো আড্ডায় মেতে ওঠার স্থান। অনেকেই হেঁটে বেড়াচ্ছে।
রাস্তায় ঢুকতেই মিউজিক। উৎসবমুখর পরিবেশ। দু’ধারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তিন শতাধিক বার ও পাব। এসব বারে-পাবে পোল ড্যান্স, স্ট্রিপ ড্যান্সের মতো মনোরঞ্জনের সব ব্যবস্থাই রয়েছে। ১০০ বাথ দিয়ে বিয়ার কিনলে বিয়ারের স্বাদ আর ড্যান্সারদের কলা-কৌশল দুইই উপভোগ্য।
বার-পাবে না ঢুকে ডান-বামের দৃশ্য দেখাতেই মন দিলাম আর সোজা হাঁটতে থাকলাম। দেখলাম দোতলা ভবনের দুইতলায় কাচের ভেতরে পুতুলের মত নাচছে তরুণী। রাস্তায় যৌনকর্মীদের অবস্থান চোখে পড়বেই।
রাত ২টায় ফিরলাম হোটেলে। পরের দিনের জন্য ৩টি আইল্যান্ড ও সমুদ্রের মাঝের চারটি দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে যাওয়ার টিকেট কিনেও নিলাম পথে। ১৫শ’ বাথ ঝরে গেলো। তবে সবার কাছে শুনেছি এই ট্যুরে টাকা উসুল হবেই।
পরের দিন সত্যি মুগ্ধ হলাম ‘ফি ফি’, ‘মায়া বে’ এবং ‘খাই’ আইল্যান্ড দেখে। সঙ্গে দেখলাম ‘মাঙ্কি’ আইল্যান্ড, যেখানে সমুদ্রের ধারে শুধু বানর আর বানর। দীর্ঘ সাত ঘণ্টার ট্যুর শেষে এবার ফেরার পালা।
টুরিস্টদের আগমনের প্রমাণ স্বরূপ সমুদ্রের পাড়ে গ্রুপ ছবি তোলা হয়। আমাদের ছবিও তোলা হল। তবে ট্যুর শেষ করে বোট থেকে তীরে নামতেই দেখলাম সে ছবি সুন্দর একটি ফ্রেমবন্দি হয়ে ঝুলে আছে। ৩০০ বাথ করে বিক্রি হচ্ছে। টাকাটা বড় নয়, কিনে নিলাম। আর অবাক হলাম পর্যটন শিল্প নিয়ে এদের পেশাদারিত্ব দেখে।
তিন দিন ফুকেটে ঘুরে বুঝতে কষ্ট হলো না- লাখ টাকা খরচ করে পৃথিবীর অন্য দেশের নাগরিকেরা থাইল্যান্ডে কেন আসেন!
(আগামী পর্বে থাকছে- ‘ফি ফি’, ‘মায়া বে’, ‘খাই’ ও ‘মাঙ্কি’ আইল্যান্ড পরিদর্শন ও বিচে মাছের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার মোহনীয় অভিজ্ঞতার বর্ণনা)
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৪, ২০১৪