ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

ইউনাইটেডের ট্যাক কৌশল, ৬০ লাখে পাইলট ও চাকরি!

ইশতিয়াক হুসাইন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৭ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৪
ইউনাইটেডের ট্যাক কৌশল, ৬০ লাখে পাইলট ও চাকরি!

ঢাকা: বৈমানিক হিসেবে প্রশিক্ষিত করে, শতভাগ চাকরির নিশ্চয়তা (!) দিয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের বৈমানিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান।   ট্যাক এভিয়েশন লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটির এই অভিনব কৌশলকে এরই মধ্যে প্রতারণার সামিল বলে চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

কারণ এই প্রক্রিয়ায় বৈমানিক হয়ে আকাশে ওড়ার স্বপ্নে বিভোর তরুণ-তরুণীদের গুনতে হচ্ছে ৬০ লাখ টাকা। অর্ধকোটি টাকারও বেশি অংশ খরচ করেই যে তারা আকাশে উড়োজাহাজ ওড়াতে পারছেন তা নয়। ফলে শতভাগ চাকরির গ্যারান্টিও এক ধরনের ধাপ্পাবাজি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।  

ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী। ট্যাক বা টিএসি তার নামেরই সংক্ষিপ্ত রূপ।  

প্রতারণার দিকগুলো সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীলসূত্র বাংলানিউজের নজরে এনেছে।
 
ফ্লাইট প্রশিক্ষণের জন্য ট্যাক নিচ্ছে প্রশিক্ষণার্থী প্রতি ফ্লাই আওয়ার হিসেবে ৩৫ লাখ টাকা। কড়ায় গণ্ডায় হিসাব করে পুরো টাকাটা অগ্রীম দিয়েই ইউনাইটেডে যুক্ত হতে হচ্ছে। ফলে এর মধ্য দিয়ে স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণীরা পা দিচ্ছে প্রতারণার ফাঁদে।

চটকদার বিজ্ঞাপনে চাকরির নিশ্চয়তার কথাও বলেছে ট্যাক। সেখানেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে, ৩৫ লাখ টাকায় বৈমানিক, চাকরি নিশ্চিত। কিন্তু প্রশিক্ষণ শেষ হলেই আসে কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স (সিপিএল) এর প্রসঙ্গ। ফলে যারা প্রশিক্ষণ পেলেই চাকরি এই স্বপ্নে বিভোর হয়ে ৩৫ লাখ টাকা খরচ করে ফেলেন তখন তাদের সামনে আসে ২৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকার লাইসেন্স ফি।

বিশাল অঙ্কের এই অর্থ খরচ তখন হয়তো অনেকের পক্ষেই করা সম্ভব হয় না। আর এতে স্বপ্নভঙ্গ হয়। প্রশিক্ষণ নিয়েও আকাশে ওড়া হয় না অনেকের।

আর যারা তাতেও রাজি হয়ে যান তখন তাদের সইতে হয় আরেক প্রতারণা। যারা এরই মধ্যে ইউনাইটেডের এই প্রক্রিয়ায় নিজেদের জড়িয়েছেন তাদের কাছেই জানা গেলো- লাইসেন্সে ২৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকার কথা বলা হলেও তাদের দিতে হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। এভাবে কোনো কারণ দেখানো ছাড়াই প্রত্যেকের কাছ থেকে বাড়তি সোয়া লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ইউনাইটেডের ট্যাক অথবা তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী।

সূত্র জানায়, ট্যাক এভিয়েশনে বর্তমানে ২৬ জন প্রশিক্ষণার্থী রয়েছে। এর মধ্যে প্রথচ ব্যাচে ভর্তি হয় ১২ জন, দ্বিতীয় ব্যাচে ৭ জন এবং তৃতীয় ব্যাচে ৫ জন। সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে তাদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র।

‍আকর্ষণীয় এই পেশার জন্য ব্যচে ব্যাচে প্রশিক্ষণার্থী বাড়বে সে প্রত্যাশাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইউনাইটেডের বিশেষ করে ট্যাকের প্রতারণার কারণে এই সংখ্যা জ্যামিতিক হারে কমছে।  

ফ্লাইট বিলম্ব, একের পর এক রুট চালু করে পুনরায় তা বন্ধ করে দেওয়াসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত ইউনাইটে এয়ারওয়েজের অবস্থা আগে থেকেই শোচনীয়। বাংলানিউজেও এসেছে এই ফ্লাইট অপারেটরটির বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ। উড়োজাহাজে এসি কাজ না করা, ভাঙাচোরা আসন, সার্ভিসের বেহাল দশা এসব নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু কিছুতে কিছু হয়নি; ইউনাইটেড এসবের সমাধানে এগিয়ে আসেনি।

সূত্র জানিয়েছে, এরই মধ্যে বড় ধরনের দেনায়ও পড়েছে ইউনাইটেড। এয়ারওয়েজটির কাছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষেরই (বেবিচকের) পাওনা ৭৭ কোটি টাকার ওপরে। এই অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় বেবিচক ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের উড্ডয়ন বাতিলের হুমকিও দেয়। পরবর্তী সময়ে মুচলেকা দিয়ে তিন মাসের জন্য উড্ডয়নের অনুমতি পায় তারা।

আর্থিক দুরবস্থা ও অব্যবস্থাপনার কারণে এরই মধ্যে ইউনাইটেডের দুবাই, সিঙ্গাপুর ও ব্যাংকক রুট বন্ধ হয়ে গেছে। এর বাইরে ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে অনেক রুটে। এভাবেই ধুঁকে-ধুঁকে চলছে এয়ারলাইন্সটি।

ফ্লাইট অপারেশন্সে এমনই যখন বেগতিক অবস্থা তখন বৈমানিক প্রশিক্ষণের উদ্যোগকে অনেকেই হাস্যকর হিসেবে দেখছেন। কেউ কেউ একে ট্যাক কৌশল বা  তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরীর টাকা আয়ের কৌশল বলেই উল্লেখ করেছেন।    

বিমান চলাচল খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেভাবে ইউনাইটেড চলছে তাতে যেকোনো সময় এটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় কিভাবে তারা নিজেদের এয়ারলাইন্সে চাকরির নিশ্চয়তা দিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে পারে। তাছাড়া এরই মধ্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী ২৬ জন বৈমানিককে চাকরি দেওয়ার মতো এত বড় এয়ারলাইন্স নয় এটি।

তাদের মতে, এটি এক ধরনের প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।  
 
এদিকে এয়ারলাইন্সটির এই প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে ইচ্ছামতো ফি আদায়ে এয়ারলাইন্সের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না।

এ ব্যাপারে বেবিচকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, কারো ফি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বেঁধে দিতে পারে না। তাই ব্যাপারে তাদের কিছু করার নেই।

তবে একই ধরনের প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমিতে খরচ হচ্ছে ট্যাকের তুলনায় অন্তত ১০ লাখ টাকা কম।
২২ থেকে ২৫ লাখ টাকার মধ্যে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করছে একাডেমি।

এ ব্যাপারে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাবেক বৈমানিক বাংলানিউজকে বলেন, বৈমানিক তৈরির নামে এভাবে ইচ্ছামতো ফি নেওয়া অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।     

ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের মুখপাত্র ও অ্যাসিসট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার (এজিএম) কামরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ট্যাকের যেহেতু এয়ারলাইন্স রয়েছে সেহেতু আমাদের পক্ষে পাস করা বৈমানিককে চাকরির নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব।

বেশি ফি আদায় করার বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১১০৬ ঘন্টা, মে ১৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।