কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া থেকে: মানুষ হিসেবে আমি ‘বাবুই পাখি’ মার্কা। ‘কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়’- এই নীতিতে বিশ্বাসী! তাছাড়া বাঙালি নারীর দুর্নামতো রয়েছেই।
মালয়েশিয়া পৌঁছে বিমানবন্দরে আর ফ্লাইটে প্রবাসে ভাগ্যের খোঁজে ছুটে চলা বাংলাদেশি নারীদের যেভাবে দেখতে পেলাম তার সঙ্গে আমার এই ভাবনার কোনো মিল নেই। বাঙালি নারী আজ ছুটছে। সমান তালেই ছুটছে দেশে এবং বিদেশেও। সে নিয়ে পরে লিখবো এখন লিখতে চাই ঘন্টা পাঁচেকের একটি আকাশভ্রমণ নিয়ে।
এক কথায় বলা যায় ভ্রমণটি ছিলো স্বস্তির। ফ্লাইট ডিলে খুব শুনতাম। কিন্ত রিজেন্টের ক্ষেত্রে সেটা হলো না। এতে একটু ক্ষতিই হলো। যাত্রার আগে শেষের দিকে যাদের সঙ্গে কথা বলবো বলে ঠিক করে রেখেছিলাম তাদের কল করার আগেই কেবিন ক্রুর ঘোষণা এলো, ‘আমরা উড়ছি, মোবাইল ফোন বন্ধ রাখুন। ’
ফোন বন্ধ করে মাথায় কাপড় টেনে দিয়ে দ্রুত দোয়া পড়া শুরু করলাম।
মালয়েশিয়ায় যে অ্যাসাইনমেন্টে যাচ্ছি তাতে সহযাত্রী সহকর্মী সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট মাজেদুল নয়নও। এর আগেও একবার মালয়েশিয়া-ভারত গিয়ে পাকা বিমানযাত্রী। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো- আমি যা করছি তা নাকি দাদী-নানীদের আচরণ। কটমট চোখে সহকর্মীর হাসি অগ্রাহ্য করলাম।
বিএনপি অফিসের সামনে ককটেল খেতে পারি, তাই বলে কি মহাশুণ্য দিয়ে বিমান চলবে আর ভয় পাবো না!
পরিপাটি, স্মার্ট ক্রু’রা ততক্ষণে নিয়মকানুন বুঝিয়ে দিতে ব্যস্ত। ঘুরে ঘুরে শিশু ও বয়ষ্কদের সিট বেল্ট বাধতে সাহায্য করছিলেন তারা। তাদের সুন্দর আর হাসিমুখে আন্তরিকতায় কাজটি করতে দেখে ভালো লাগলো। এয়ারওয়েজের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে বাস্তবের মিল দেখে অস্ফূট স্বরে বললাম- বাঃ বেশতো।
মাজেদুল নয়নও একমত, সার্ভিস ভালো।
ককপিট থেকে ঘোষণায় বলা হলো- আকাশে মেঘ রয়েছে, তাই হালকা ঝাঁকুনি হতে পারে। ক্যাপ্টেন আব্বাস ফ্লাইট ওড়াচ্ছেন। ফ্লাইট কত মিটার ওপর দিয়ে যাবে, কখন পৌঁছাবে ইত্যাদি ইত্যাদি তথ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন।
বাইরে তখন রাতের আঁধার। মেঘ মেঘে ঘর্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তার মধ্যে এগিয়ে চলছে রিজেন্ট।
সিটবেল্ট খোলার সিগন্যাল দেখা গেলো। যাত্রীদের মধ্যে কয়েকজনের শিশু সন্তান রয়েছে সঙ্গে। তারা যেনো এই সময়টিরই অপেক্ষায় ছিলো। সিট বেল্ট খুলে তারা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। খালি পায়ে এদিক সেদিক ছুটছে তারা।
ছয় বা সাত বছরের এক কন্যাশিশুর মাথায় লম্বা চুল, সেগুলো আবার বেণী করা। তার আনন্দ আর স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিলো বাড়ির ড্রয়িং রুমে খেলছে সে।
জানলাম নাম অপরাজিতা।
এযুগে নারীরা আসলেই অপরাজিতা। শিশু অপরাজিতাই যেনো তার প্রতীক, ভাবলাম মনে মনে।
রিজেন্ট এয়ারওয়েজের প্রশংসা করতেই হয়। তাদের থিমের যথার্থতা দেখলাম সার্ভিসে। প্রতিটি ছোটখাট বিষয় নজরে রাখছেন ক্রুরা।
ফ্লাইটের ভেতরটা পরিপাটি-পরিচ্ছন্ন। সিটগুলোর ওপরে রিমুভেবল কভার ময়লামুক্ত। ইকোনমি ক্লাসেও সিটগুলো চওড়া, আরামদায়ক। ভালো লাগলো।
রাতের খাবার এলো। সুস্বাদু-পর্যাপ্ত। ক্ষুধা বেশি পেয়েছিল কিনা জানি না, সবটুকু খাবার তৃপ্তি করে চেটেপুটে খেয়ে নিলাম।
এবার অভিজ্ঞতা থেকে শেয়ার করতে শুরু করলো সহকর্মী মাজেদুল নয়ন। কোন প্লেনে খাবার কেমন, সিট কতটা ‘চিপা’ তা বর্ণনা করে সেও একমত, রিজেন্ট এয়ার তার অভিজ্ঞতায় থাকা অন্য এয়ারওয়েজগুলোর চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো।
ওয়াশ-রুমের পরিচ্ছন্নতা আমার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেদিক থেকেও রিজেন্টকে ধন্যবাদ দিতেই হয়।
এরপর নির্জলা বসে থাকার সময়। জানালা দিকে বাইরে তাকিয়ে ফেলে আসা ঘর-সংসার আর প্রিয় মানুষগুলোর কথা ভাবছি আর রাতের আকাশে কখনো চোখে পড়ছে বিদ্যুৎ চমকানো। কখনো দেখছি নিচে ঝলমল আলোর শহর। হাজার হাজার ফুট উপর দিয়ে (অভিজ্ঞ!) নয়ন বলছে আমরা থাইল্যান্ডের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। মনে মনে হাসি ছাড়া প্রতিবাদের উপায় নেই কারণ আমিও নিশ্চিত করে জানিনা কোন শহর।
অফিসের দেওয়া কাজগুলো নিয়ে ভাবার চেষ্টা করলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম, কীসের শাস্তি হিসেবে এবার দেশছাড়া করলেন আমাদের এডিটর ইন চিফ (আলমগীর হোসেন)! কত ভালো কাজ করছিলাম! কত খাঁটুনিইতো করছিলাম! এটা কি কোনও শাস্তি নাকি পুরস্কার!
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বসেও কয়েক দফায় যোগাযোগ হয় এডিটর ইন চিফের সঙ্গে। মনে হচ্ছিলো- তিনিও কম টেনশনে নেই আমাদের পাঠিয়ে। তবে আগেই বলেছিলেন- আমি তোমাদের নির্বাচন করছি, কারণ আমি জানি তোমরাই পারবে।
মাত্র চার ঘন্টায় ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর এসে পৌঁছাই। এয়ারপোর্টেই বাকি রাত কাটিয়ে সকাল থেকে হোটেলে ওঠা ডলার ভাঙানো, মোবাইল ফোনের সিম কেনাসহ নানা কাজের ব্যস্ততা ছিলো।
বৃহস্পতিবার বিকেলের নরম আলো, না শীত না গরম একটা আবহাওয়া। কুয়ালালামপুরের বুকিত বিনতানের একটি রেস্টুরেন্টে বসে আছি। এখানে বসেই লিখে ফেললাম রাতের ভ্রমণ কথা।
এরই মধ্যে অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে গেছে। বাংলানিউজে আমার আর মাজেদুল নয়নের নামে লেখা হয়েছে- চ্যালেঞ্জিং অ্যাসাইনমেন্টে আমরা মালয়েশিয়ায়। লেখা হয়েছে আমরা নাকি এডিটর ইন চিফের ফেভারিটিজম পেয়েছি, যা আমাদের অর্জন। শাস্তি নয় এই সফর পুরস্কারের, স্পষ্ট জেনে ভালো লাগতে শুরু করেছে। আরও একটি খবর পেলাম, আমাদের দুজনকে আরও ছয় সহকর্মীর সঙ্গে স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছেন এডিটর ইন চিফ।
দারুণ খুশি লাগছে। আর ভাবছি দায়িত্বও বেড়ে গেলো অনেকাংশে। এখন শুধুই প্রত্যাশা পূরণের পালা। তাই ‘শো মাস্ট গো অন’!
বাংলাদেশ সময়: ২০২৫ ঘন্টা, জুন ০৫, ২০১৪