ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে উদ্বাস্তু হচ্ছে উপকূলবাসী

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০২৩
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে উদ্বাস্তু হচ্ছে উপকূলবাসী খোলপেটুয়া নদীর বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে গিরিন্দ্রনাথ রপ্তান মাঝ নদী বরাবর তার বাড়িঘরের নিশানা দেখাচ্ছিলেন

সাতক্ষীরা: ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর ১২টা ছুঁই ছুঁই। সূর্য মাথার উপর।

খোলপেটুয়া নদীর জরাজীর্ণ বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে ষাটোর্ধ্ব গিরিন্দ্রনাথ রপ্তান হাতের ইশারায় মাঝ নদী বরাবর তার বাড়িঘরের নিশানা দেখাচ্ছিলেন। দুঃখ নিয়ে জানাচ্ছিলেন তার অতীতের কথা। শোনাচ্ছিলেন নিঃস্ব হয়ে পথে বসার গল্প।  

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পশ্চিম দূর্গাবাটি গ্ৰামের বাসিন্দা গিরিন্দ্রনাথ রপ্তান জানান, এ গ্ৰামে আগে চারশ পরিবার বসবাস করত। এর মধ্যে দুই শতাধিক পরিবারের ভিটেমাটি ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।  

তাদের কেউ কেউ পাড়ি জমিয়েছেন দেশের বিভিন্ন জেলায়, কেউবা প্রতিবেশী দেশ ভারতে। এর মধ্যে গিরিন্দ্রনাথ রপ্তানের দুই ভাই সুকুমার রপ্তান ও সুকুপদ রপ্তানের পরিবারও চলে গেছে ভারতে। তবে, জন্মভূমি ছাড়েননি গিরিন্দ্রনাথ রপ্তান।

গিরিন্দ্রনাথ বলেন, ২০০৯ সালে আইলায় (ঘূর্ণিঝড় আইলা) দূর্গাবাটির বেড়িবাঁধ ভেঙে আমাদের সবকিছু নদীগর্ভে চলে যায়। শুধু আমাদেরই নয়, এখানে বসবাস করত রপ্তান, সরকার ও মোড়ল গোষ্ঠীর লোকেরা। তিন গোষ্ঠীরই বেশিরভাগ সহায়-সম্পত্তি ও ঘরবাড়ি এখন নদীর মাঝখানে। আমরা কোনোমতে অন্যের জায়গায় একটি খুপরি ঘর বেঁধে বসবাস শুরু করি। পরে এক খণ্ড জমি কিনে ঘর বাঁধি।

কেন এভাবে উদ্বাস্তু হচ্ছে উপকূলের মানুষ, তার প্রধান কারণ যে জলবায়ু পরিবর্তন, সেই সম্পর্কে গিরিন্দ্রনাথের ধারণা নেই। তবে তিনি জানান, ২০০৯ সালের পর প্রতিবছরই এক বা একাধিক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত হয়েছে উপকূলের প্রতিটি পরিবার। কেউ ঘর-বাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন, কেউবা হারিয়েছেন ফসলের জমি।  

তিনি জানান, অনেকে কর্ম হারিয়ে ছেড়েছেন এলাকা। সেইসঙ্গে বিনষ্ট হয়েছে এলাকার প্রাণবৈচিত্র্য, খাদ্য নিরাপত্তা। বাসিন্দাদের দেহে বাসা বেঁধেছে পুষ্টিহীনতা, বিস্তার লাভ করেছে রোগ বালাই। বেড়েছে বাল্যবিয়ে, ঝরে পড়ছে শিশুরা, বাধ্য হচ্ছে শিশুশ্রমে।

একই এলাকার বাসিন্দা সুপদ মন্ডল (৬২) বলেন, বারবার প্রাকৃতিক দুযোর্গের কারণে উপকূলের প্রতিটি পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু পশ্চিম দূর্গাবাটি গ্ৰামেরই ৩০টি পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়েছে।

স্থানীয় লক্ষ্মী রানী রপ্তান বলেন, পশ্চিম দূর্গাবাটি গ্রামে এখন আর ধান হয় না। বার বার ঘূর্ণিঝড় আর নদী ভাঙনে পুরো এলাকা লবণাক্ত হয়ে গেছে। এজন্য এলাকায় আর কাজ নেই, অনেকের ঘরে খাবারও থাকে না। আমার চোখে দেখা নদীর মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে সরকার, রপ্তান ও মোড়ল বংশের প্রায় এক হাজার বিঘা জমি।  

শুধু পশ্চিম দূর্গাবাটি গ্ৰামই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে শ্যামনগর উপকূলের পদ্মপুকুর, গাবুরা, মুন্সীগঞ্জ, কৈখালী, আটুলিয়া ও কাশিমাড়ির হাজারো পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে

জলবায়ুকর্মী এসএম শাহিন আলম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলের মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছে। সংকট দিন দিন আরও বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করে উপকূলের মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। জলবায়ু ট্রাস্টের অর্থ জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্তদের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০২৩
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।