অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে: বিবর্তন কিংবা বিপ্লব, যাই বলুন ক্রিকেটে তার অনেক কিছু অস্ট্রেলিয়ানদের মস্তিস্কজাত। ওয়ানডে ক্রিকেট সেটা অস্ট্রেলিয়ানদের মাথা থেকে এসেছে।
ক্রিকেটে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারেও অন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে স্যার ডনের দেশের মানুষরা। কেরি প্যাকার নামক এক ক্রিকেট সওদাগর অস্ট্রেলিয়ায় রাতের আলোয় রঙ্গিন পোশাকে ক্রিকেট খেলিয়েছেন নিছক বাণিজ্যের কথা মাথায় রেখে। প্রথম প্রথম এটাকে গেলো গেলো বলে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তারা ক্রিকেটের সেই বাণিজ্যিক আগ্রাসন মেনে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দেখলেন রঙ্গিন পোশাকের প্রথম বিশ্বকাপ। সেটা ’৯২ এর বিশ্বকাপ। তারপর থেকেই ক্রিকেটে রঙের ছোঁয়াটা অনেক বেশি। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দ্বিতীয় বিশ্বকাপেও সেই রং আছে।
যদিও আয়োজন দেখে অনেকে বলছেন; এখানে বিশ্বকাপ কেন যেন একটু ফ্যাকাশে! এরকম কাপ টাপের আয়োজক হিসেবে উপমহাদেশ সবাইকে পেছনে ফেলবে। অতীতেও ফেলেছে। তর্কাতীত ভাবে, সংশয়হীনচিত্তে সেটা মেনে নেবে হয়তো বাকি ক্রিকেট বিশ্বও। কিন্তু ক্রিকেটীয় চিন্তায়? এই জায়গাটায় অন্যদের থেকে এগিয়ে অস্ট্রেলিয়া।
হ্যাঁ, অন্যদের অনেক কিছু নতুন করে ভাবাতে পারে অস্ট্রেলিয়ানরা। কারণ, তারা নিজেরা অনেক বেশি ক্রিকেট মনস্ক। বেশি চিন্তাশীল। বিশ্বকাপের প্রথম সপ্তাহেই যখন আবাহওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস; ব্রিসবেনে আঘাত হানতে পারে সাইক্লোন; বৃষ্টিতে ভেসে যেতে পারে শনিবারে অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ ম্যাচ। ঠিক সেই সময় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ওয়ার্ল্ডকাপ ম্যাজিক মোমেন্টে বার বার দেখানো হচ্ছে গত শনিবার মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড ম্যাচের দুর্দান্ত একটা ক্যাচ! স্টিভ স্মিথ ক্রিকেটে অ্যাথলেটিজমের চূড়ান্ত নিদর্শন দেখিয়ে সেদিন জশ বাটলারের ক্যাচটা নিয়েছিলেন। এক হাতে ওরকম একটা ক্যাচ নেওয়া যে কোন ক্রিকেটারের জন্য স্বপ্নের ব্যাপার। আর যে ব্যাটসম্যান ক্যাচে পরিণত হন তার জন্য রীতিমতো দুঃস্বপ্নের বিষয়!
জন্টি রোডসের অনেক ম্যাজিক মোমেন্টের কথা রেখেও তাই অস্ট্রেলিয়ানরা বলছেন, বিশ্বকাপে এটাই সেরা ক্যাচ! হয়তো বা তাই। হয়তো বা না। তবে এই ক্যাচের পর অস্ট্রেলিয়ান দলের এক কোচিং কনসালটেন্ট মাইক ইয়াং অবশ্য নতুন এক ভাবনার খোরাক দিয়েছে ক্রিকেট বিশ্বকে। ক্রিকেট কর্তাদের। ভদ্রলোক মূলত বেসবলের কোচ। কিন্তু টানা চারটা বিশ্বকাপে তিনি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দলের সঙ্গে রয়েছেন তাদের ফিল্ডিং নিয়ে কাজ করতে। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন; ক্রিকেট পরিসংখানের খেলা। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেই পরিসংখ্যানে অনেকের অনেক দক্ষতার প্রতিফলন থাকছে না। বিশেষ করে ফিল্ডাররা যখন ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিচ্ছেন কিংবা ম্যাচের রং পাল্টে দিচ্ছেন সেটা কি পরিসংখ্যানে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে? কিংবা ভবিষতে পাওয়া যাবে? নিজের এই প্রশ্নের পেছনে উদাহরণ হিসেবে টেনে এনেছেন স্টিভ স্মিথের ঐ অ-সা-ধা-র-ণ ক্যাচটার কথা।
তার যুক্তি, পরিসংখ্যান ঘাটলে কেউ হয়তো ভাববেন এবারের বিশ্বকাপে স্মিথের প্রথম ম্যাচটা ভাল যায়নি! মাত্র ৫ রান করেছেন তিনি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। অথচ গোটা সামারে দারুন ফর্মে স্মিথ। ওটাই এই সামারে তার সবচেয়ে কম রানের ইনিংস। ইয়াং এর প্রশ্ন, আসলেই খারাপ গেছে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচটা স্মিথের। মোটেও না। বরং এই ম্যাচটাই তিনি অনেক দিন মনে রাখবেন ওরকম একটা ক্যাচ নেওয়ার জন্য। বাটলারের গড় ৩১। কিন্তু এ ম্যাচে তাকে ১০ রানে ফিরতে হলো যার জন্য তিনি স্মিথ। কিন্তু পরিসংখ্যানে এর কোনো কিছুই লেখা থাকবে না।
এটা মেনে নিতে পারছেন না ইয়াং। আইসিসি এবং ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কর্মকর্তাদের কাছে তার প্রস্তাব; কোন ফিল্ডার ক’টা রান সেভ করলেন সেটা স্কোরশিটে লেখা থাকা উচিৎ। কোন ফিল্ডার পুরো ক্যারিয়ারে সরাসরি থ্রো-তে ক’জন ব্যাটসম্যানকে আউট করেছেন সেটাও ক্যাচের মতো পরিসংখ্যানের খাতায় লেখা থাকা উচিৎ। তার ভাষায়; ‘ক্রিকেটে রান সব সময় রান। সেটা কোন ব্যাটসম্যান স্কোর করলেও রান। আবার কোন ফিল্ডার সেভ করলেও রান। ’ তাই রান যিনি সেভ করলেন তাকে কিছু কৃতিত্ব দিতে হবে পরিসংখ্যানের পাতায়। নিজের এই নতুন চিন্তার কথাটা তিনি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কর্তাদের জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে দাবি করেছেন অ্যালেন বোর্ডার মেডেলের মতো সেরা ফিল্ডারের জন্য‘ রিকি পন্টিং ফিল্ডিং অ্যাওয়ার্ড’-এর প্রচলন ঘটাতে। যা অস্ট্রেলিয়ানদের ফিল্ডিঙে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
মাইক ইয়াং এর নতুন এই চিন্তাটা আপাত ভ্রুণের পর্যায়ে। কিন্তু আগামীতে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া যদি সেটা প্রসব করে, তাহলে বাকি বিশ্বকে সেটা লালন পালন করে বড় করতে হতে পারে। তখন হয়তো ক্রিকেট লিখিয়েদের লিখতে হবে, এক বেসবল কোচের চিন্তার কারণে ক্রিকেটের স্কোরশিটের চেহারায় কিছুটা পরিবর্তন হলো। যেখানে একজন ফিল্ডার এক ম্যাচে ক’টা রান সেভ করলেন সেটাও থাকছে। আর আগামী প্রজন্মেও ক্রিকেটারদের শুধু রান করলেই দলে জায়গা হবে তা নয়। রান সেভ করার স্কিলও দেখাতে হবে তাদের। ক্রিকেটের সেই বিবর্তনের চিন্তাটা বোধহয় শুরুই হয়ে গেলো। আপাত যাকে অনেকের কাছে মনে হতে পারে বিপ্লবী চিন্তাভাবনা!
বাংলাদেশ সময়: ১২২৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৫
** পলিটিক্যাল হাব-এ ডেমোক্রেসি মিউজিয়াম
** ম্যাচের নায়করা ছিলেন বাইশ গজের বাইরে। । অঘোর মন্ডল, ক্যানবেরা থেকে