ব্রিসবেন থেকে: ঢাকা যখন ভাসছে ভাষা দিবসের আবেগে তার ঠিক কয়েক ঘন্টা আগে ব্রিসবেনে বসে বুঝে ওঠা যাচ্ছে না; ‘সি’ ফর ক্রিকেট নাকি সাইক্লোন! বিশ্বকাপ ম্যাচ নিয়ে ক্রিকেটীয় সব আবেগের স্রোতকে পাশে সরিয়ে রেখে কুইন্সল্যান্ডের উত্তর অঞ্চলের মানুষ ভাসছে বন্যার পানিতে। সাইক্লোন ‘মার্সিয়া’ আঘাত এনেছে রকহ্যাম্পটনে।
ব্রিসবেন শহর থেকে উত্তরের ঐ শহরের দূরত্ব ৬শ ৩৬ কিলো মিটার। ৬ ঘন্টা ৫৭ মিনিটের ড্রাইভ। কিন্ত ব্রিসবেন থেকে সেই শহরমুখি সব যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শুধু বাস-প্রাইভেট কার-ট্রাক কেন, বাতিল করা হয়েছে উত্তরমুখি প্রায় সব ফ্লাইট। শঙ্কার পারদ আরো ঊর্ধ্বমুখী। পানির নিচে চলে যেতে পারে ন্যাশনাল হাইওয়ে। ব্রিসবেন বৃষ্টি ভেজা শহর সেই বৃহষ্পতিবার সকাল থেকেই। শনিবার বাঙালীর রক্ত আর আবেগ মেশানো ২১ ফেব্রুয়ারি-তেও এই শহর আরো বৃষ্টি ভেজা হবে। আবাহওয়া দপ্তর সেই পূর্বাভাস দিচ্ছে। প্রতি ঘন্টায় নিউজ চ্যানেল গুলোর শিরোনাম সেই ‘মার্সিয়া’। আর বিভিন্ন ওয়েব সাইটে চলছে সবশেষ তথ্য দেয়ার লড়াই। বলা যায় প্রতিমিনিটের আপডেট পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন ওয়েব সাইটে।
এই লেখার জন্য যখন ল্যাপটপে হাত রেখেছি, তখন চোখের সামনে ভেসে উঠলো স্কাই নিউজের সবশেষ আপডেট। তার থেকে পাওয়া তথ্য হচ্ছে, শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ব্রিসবেনে ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। শুক্রবার রাতে সেটা ছাড়িয়ে যেতে পারে দেড়শ মিলিমিটার। আর শনিবার অব্যহত থাকবে বৃষ্টি। সেই শহরে ক্রিকেট! না, খেলা হবে না সেটা জোর দিয়েই বলা যায়। কিন্তু বিশ্বকাপ ম্যাচ বলে কথা! তাই আইসিসি একটা বিবৃতি দিয়ে আশায় রেখেছে ক্রিকেট সমর্থকদের। ম্যাচের জন্য শেষ মুর্হুত পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকা হবে। হোক সেটা কুড়ি-কুড়ির একটা ম্যাচ। তাও যদি না হয় তাহলে দু’দলকে এক পয়েন্ট করে দেয়া হবে। আর গোটা ম্যাচের দৈর্ঘ্য যদি সব মিলিয়ে ২৫ ওভার না পেরুতে পারে তাহলে ফেরত দেয়া হবে দর্শকদের টিকিটের দাম। এটাই হচ্ছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার নিয়ম।
কিন্তু সল্প দৈর্ঘ্যরে ম্যাচ দূরে থাক, মার্সিয়া এখন যে দূরত্বে দাঁড়িয়ে এবং যেভাবে উত্তর থেকে দক্ষিণে ব্রিসবেনমুখি হচ্ছে; তাতে লিখে দেয়া যেতে পারে শনিবার এখানে কোন ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছে না। লিখলে তাকে বাড়াবাড়ি কিংবা বোকামি বলা যাচ্ছে না। কারণ সেই আবাহওয়া দপ্তর। সেখানকার পূর্বাভাস হচ্ছে শনিবার সারাদিনে একশ শতাংশ বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা। সঙ্গে জোরালো বাতাস। এই অবস্থায় খেলা! ভাবাও অসম্ভব। ব্রিসবেনের সাধারন মানুষ ভাবছেন বলেও মনে হচ্ছে না।
ভাববেন কিভাবে? খবরের পাতায় শিরোনাম- ‘বিওএম ( বাংলা উচ্চারণ হলে হতে পারতো -বোম) অ্যালার্ট!’ ব্যুরো অফ মিটারোলোজি-র ঐ অ্যালার্ট পেয়ে কুইন্সল্যান্ডের স্থানীয় সরকার আরো সর্তক। সর্তক অবস্থায় রাখা হয়েছে স্টেট ইমারজেন্সি সার্ভিস-এস ই এস-র ১৪শ কর্মীকে। কুইন্সল্যান্ড জুড়ে জারি আছে ‘অ্যাক্ট অ্যান্ড ওয়াচ’-এস ই এস। সেই সব কর্মীদের একজন ব্রিটিশ অস্ট্রেলিয়ান মিস্টার ডানকান যে তথ্য দিলেন সেটা আরো ভয়াবহ। শেষ পর্যন্ত জরুরি অবস্থা জারি করতে না হয় কুইন্সল্যান্ডে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসার আগ্রহ জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্থদের সাহায্যার্থে। এই প্রদেশের উত্তর জনপদ বিধ্বস্থ মার্সিয়ার আঘাতে। মার্সিয়া দুর্বল হয়ে শনিবার ব্রিসবেন অতিক্রম করবে। কিন্তু বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নেই। যে কারণে ভয়টা আরো বেশি। শেষ পর্যন্ত অতি বৃষ্টিতে আবার বন্যায় না ভাসে ব্রিসবেন শহর। এই শহরটাকে ঘিরে রেখেছে যে নদী তার নামও ব্রিসবেন। আর সেই নদীর পানি উপচে পড়ার উপক্রম। নভেম্বর থেকে মার্চ, এই সময়টায় অস্ট্রেলিয়ার এই উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টি-বন্যা নিয়মিত। কিন্তু এবার বৃষ্টির মাত্রা একটু বেশি। ভয়টাও তাই বেশি। এই ভয়-আতঙ্ককে বাউন্ডারি সীমানার বাইরে পাঠিয়ে মাঠে ক্রিকেট গড়ালে সেটা হবে চৈত্র মাসে বাংলাদেশে লেপ-কম্বল জড়িয়ে ঘুমানোর মতো!
না।
চৈত্রের বাংলাদেশ নয়। এই ব্রিসবেনকে দেখে মনে হচ্ছে শ্রাবণের বৃষ্টিস্নাত বাংলাদেশকে। আর সেটা দেখে এখানকার অনেক অভিবাসী বাঙালির ইচ্ছে জাগতে পারে গলা ছেড়ে গাইবার; ‘ও গো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না.............!’ কারণ চোখ তাকিয়ে ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট দেখার জন্য। আর তাদের মন উস্কে দিচ্ছিলো এক দশকেরও বেশি সময় আগের একটা স্মৃতি। কার্ডিফে সেবার বাংলাদেশ হারিয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে। আশায় তাই বুক বাধা ছিল, সেরকম একটা জয় যদি আবার পেয়ে যায় গাব্বায় বাংলাদেশ! জয়ের আশা দূরে থাক; বাংলাদেশ গাব্বায় একটা ম্যাচ খেলারও আশা করতে পারছে না এখন। কারণ তাদের স্বপ্ন আর আশা ভেসে যাচ্ছে মার্সিয়ার আঘাতে! কুইন্সল্যান্ডের মানুষ অনেক নাটকীয় ম্যাচ দেখেছেন গাব্বায়। কিন্তু এরকম ফাইভ ক্যাটাগারির সাইক্লোন শেষ কবে দেখেছেন তারা মনে করতে পারছেন না অনেকেই। তবে তাদের মনে আছে ২০১১-তে এই প্রদেশ জুড়ে একবার জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল। সেটা অবশ্য বন্যার কারণে। কি অদ্ভুদ! তার মাত্র বছর চারেক আগে বাংলাদেশেও জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা! যদিও কারণ ভিন্ন।
তবে ভিন্নতা নয়; মার্সিয়ার সৌজন্যে বিশ্বকাপ ম্যাচের আগে-পরে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সম্ভাবত একই সমান্তরালে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ম্যাচের আগে দুটো দলই একটা করে ম্যাচ খেলেছে। এবং জিতেছে। ব্রিসবেন থেকেও দুটো দলই পেতে যাচ্ছে এক পয়েন্ট করে। সাইক্লোনের অস্বস্তি থাকলেও একটা ক্রিকেটীয় স্বস্তি কি থাকবে না বাংলাদেশের? ব্রিসবেন থেকে একটা পয়েন্ট তো পাওয়া যাচ্ছে। সাইক্লোন আর ক্রিকেট এক বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়ে মাঠের লড়াইয়ে হয়তো বাংলদেশ অস্ট্রেলিয়া কাউকেই বিধ্বস্থ হতে দিচ্ছে না!
** শঙ্কার চোরা স্রোত ব্রিসবেনে॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** বিবর্তের নাকি বিপ্লবের চিন্তা!
** পলিটিক্যাল হাব-এ ডেমোক্রেসি মিউজিয়াম
** ম্যাচের নায়করা ছিলেন বাইশ গজের বাইরে। । অঘোর মন্ডল, ক্যানবেরা থেকে
বাংলাদেশ সময় ১৬০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৫