কক্সবাজার থেকে ফিরে: কক্সবাজার শহরের গোলদীঘির পাড়কে পশ্চিমে রেখে একটু সামনে এগোলেই উত্তরে মুখ করে থাকা ছোট্ট একটা গলি। গলির সামনে দাঁড়িয়ে মুমিনুল হক নামটা পুরো মুখে আনতে হলো না, মু.. বলে মুখ খুলতেই আশপাশের মানুষের হাতের ইশারায় দূর পানে দেখিয়ে সটান জবাব গলি হয়ে সামনে আগান….
সেখানে কবরস্থানের পাশ ধরে হেঁটে গেলে ডানে যাওয়ার আরও একটা ‘চিপা’ গলি।
সেই পথ ধরে হাঁটছি আর মনের মধ্যে ভিডিও আকারে যেনো বেজে যাচ্ছে প্রায় অন্ধকার এই গলি দিয়ে দেড়যুগ আগে সাত বছরের এক শিশু বের হয়ে যাচ্ছে, পিঠে ব্যাগ, হাতে ব্যাট নিয়ে। লক্ষ্য স্কুল সঙ্গে অবশ্যই মাঠ।
ভাগ্যিস সেই সময় সাহস দেখিয়েছিল ছেলেটা।
না হলে বাংলাদেশ ক্রিকেট এই আলো কোথায় পেতো?
ভাবতে ভাবতেই সামনে এসে দাড়াল হক ভিলা। মুমিনুল হকের আতুড়বাড়ি। এই ঘরেই ২৪ বছর আগে জন্মেছিলেন মুমিনুল হক। বাংলাদেশ ক্রিকেটের পকেট ডায়নামো।
সাদামাটা দ্বিতল বাড়িটির সদরদরজায় লাগানো কলিং বেলের সুইচ বোর্ডে আঙ্গুল লাগতেই খুলে গেল ফটক। সংবাদ কর্মী জেনে সাদরে অভ্যার্থনা জানানো হলো ভেতরে। দীর্ঘ আধাঘণ্টা খোঁজাখুজির পর অবশেষে লিটল মাস্টারের চির পুরাতন ঘরে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া গেলো; আহা !!!
কিন্তু প্রথমেই দুঃসংবাদ। মুমিনুল হকের বড় ভাইয়ের স্ত্রী বলে দিলেন, ‘মিডিয়ায় কথা বলা আমাদের বারণ আছে। ’ গলা শুকিয়ে যাওয়ার জোগাড়।
তবে কয়েক সেকেন্ড থেমে বললেন ‘একটু অপেক্ষা করুণ, আব্বা আসুক। ’ আব্বা মানে মুমিনুল হকের বাবা নাজমুল হক।
সাজানো গোছানো ড্রইং রুম। একটা ক্যাবিনেটে পর পর রাখা, টুপি, পদক, নানান পুরস্কার। এসবের এক পাশে তিনি হাসছেন। তিনি মানে এসবের মালিক বাড়ির ছোটো ছেলে মুমিনুল হক।
একটা সময় নাকি মুমিনুল হকের বাড়ি যাওয়ার শহরের প্রায় অন্ধকার এসব গলিতে একটা ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করতো। কিন্তু সেসব এখন অতীত। সমুদ্র শহর থেকে ওঠে আসা বিস্ময় বালকের কল্যাণে অন্ধকার এখন ‘জাদুঘরে’।
আর বৈশ্যারঘোনার এ হালকা সবুজ রংয়ের দ্বিতল বাড়িটার কথা বলুন। এই বাড়িটাই এখন পুরো শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত ঠিকানা, আবেগের উৎপত্তিস্থল। ওই বাড়িটিই যে এই শহরের বিখ্যাত ‘বাসিন্দা’ মুমিনুল হকের আতুরভূমি।
এর আগে মুমিনুলের বাড়িতে যেতে যেতে কথা হচ্ছিল স্থানীয়দের সঙ্গে। তারা জানালেন, মুমিনুল সেঞ্চুরি করলে এই এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়। বিভেদ তুলে রেখে কোলাকুলি, হাসি আড্ডায় মেতে উঠেন এলাকাবাসী। আর মুমিনুল বাড়ি আসলে তো কথাই নেই। এই গলিতে মিছিল নামে, লেগে থাকে থিকথিকে ভিড়। পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবে ঠাসাঠাসি। ক্ষণে ক্ষণে শোনা যায়, ‘মুমিনুল ভাইয়ের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’।
মুমিনুল হকের সেই ‘জাদুঘরসম’ ড্রইংরুমে নাজমুল হকের অপেক্ষায় কেটে গেল ১০ মিনিট। চা-নাস্তাও শেষ। কিন্তু তার খবর নেই। তিনি কি আজ আর আসবেন না? মনের মধ্যে এমন প্রশ্ন আসার পরের ৩০ সেকেন্ডেই তিনি আবির্ভূত হলেন।
এসেই জুড়িয়ে দিলেন আড্ডা। মুমিনুল হকের বাবা ভুলে নাজমুল হক যেনো পাশের বাড়ির সেই আঙ্কেলটা।
২০০৪ থেকে এই পর্যন্ত মুমিনুল নামা তুলে ধরলেন একে একে।
নাজমুল হক বলেন, ‘স্কুল পর্যায়ে নিয়মিত খেলতো মুমিনুল। ২০০৪ সালে কক্সবাজারে ক্রিকেট প্রতিভা বের করে আনার একটি প্রতিযোগিতা হয়েছিল। সেখানে মুমিনুলের ব্যাটিং চোখে লেগে যায় বিকেএসপির কোচ নাজিমের। এরপর তিনি আমাদের বলে দিলেন ছেলেকে যাতে বিকেএসপিতে ভর্তি করাই। তারপর ২০০৪ সালের জুলাইয়ে বিকেএসপিতে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হল মুমিনুল। ’
দারুণ সম্ভাবনাময়ী ছিলেন, তা ঠিক। অভিষেকের প্রথম বছরে মুমিনুলময় কিছু দেখেনি ক্রিকেট বিশ্ব। টুকটাক যা করেছেন তাও ডাকা পড়েছে তামিমে-সাকিবের তারকাদ্যুতিতে। ২০১৩ সালের শেষের দিকে দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত নিউজিল্যান্ড সিরিজেই মুমিনুলের জাদু দেখা গেল।
এরপরের এ তিনবছরের হিসেব যদি করতে হয় তাহলে মুমিনুল হক লিখে গুগলে সার্চ দিলেই হবে। সেখানে অনেক কিছুই বেরোবে, ইন্টারনেট দেখাবে-
‘টানা ১১ টেস্টে হাফ সেঞ্চুরি মুমিনুল হকের’।
‘টেস্ট গড়ে ব্যাডম্যানের পরেই মুমিনুল হক’।
আরও কত চোখ জুড়ানো শিরোনাম?
সময়ের ব্যবধানে হয়তো এই শিরোনামগুলোর তারতম্য ঘটেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের ৫ ফিট সাড়ে ৩ ইঞ্চির ছেলেটা যা করেছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে শুরুর দিকেই আগে কি কেউ এভাবে দেখাতে পেরেছেন?
ক্রিকেট বিশ্ব মুমিনুলের দ্যূতি অনেক পরে দেখলেও, একজন আগেই জানতেন একদিন ঠিকই বিশ্ব ক্রিকেটে শাসন করবেন মুমিনুল।
সেই তিনি হলেন নাজমুল হক।
মুমিনুল হকের বাবা বলেন, ‘ছেলের ওপর আমার অগাধ আস্থা ছিল। মনেপ্রাণে বিশ্বাস ছিল আমার ছেলে একদিন দারুণ কিছু করবে। তার কল্যাণেই আমাদের চিনবে সবাই। সেই বিশ্বাস আমার তার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেও ছিল, এখনও আছে। আমার ছেলের পাশে থাকুন, দোয়া করুন। ইনশাআল্লাহ দেশকে আরও অনেক কিছুই দেবে আমার ছেলে। ’
ভীষণ ‘এলাকা’ অন্তপ্রাণ মানুষ নাজমুল হক। ছেলে জাতীয় তারকা। সামর্থ্যের অভাব নেই। চাইলেই শহরের আরও ভালো জায়গায় বাড়ি করে থাকতে পারেন অনায়সে। ঢাকায় ফ্ল্যাট আছে মুমিনুলেরও। সেখানেও তো আরামসে থাকা যায়।
এই কথা তুলতেই মুখের কথা টেনে নিয়ে নাজমুল হকের বক্তব্য, ‘এ গ্রাম আর এই শহরের মানুষের প্রতি আমাদের আলাদা একটা দায়িত্ব আছে। তাদের সবার দোয়াই তো মুমিনুল আজ এ পর্যায়ে। তাদের ছেড়ে কোথায় যাবো?’
এবার আসা যাক মূল প্রশ্নে।
ছেলে যখন ব্যটিং করেন, তখন নিশ্চয় আপনি টিভির সামনে বুঁদ হয়ে থাকেন, এমন প্রশ্নে নাজমুল হকের ‘আতঙ্কিত’ জবাব, ‘ওরে বাবা কী যে বলেন, এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি কখনও তার খেলা দেখি না। পরিবারের অন্যরা মাঠে গিয়ে তার খেলা দেখে নিয়মিত। আমাকেও যেতে বলে খেলা দেখতে। কিন্তু আমি যাই না। কারণ সে যখন ব্যাটিং করে আমার খুব টেনশন হয়। কী না কী হচ্ছে। তার আউট দেখতে আমার ভালো লাগবে না। তাই শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, যাতে আমার ছেলেটা ভালো করে। ’সাক্ষাৎকারের একেবারেই শেষের দিকে। ওদিকে আজান পড়ছে মাগরিবের। এবার নাজমুল হককে বিদায় দিতেই হবে। কিন্তু মুমিনুলের মা জয়নাব বেগম কোথায়?
মুমিনুলের ঘর ত্যাগ করবো এমন সময় তিনিও ঢুকলেন ঘরে। এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তিনি অসুস্থ্য, কথা বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
মুমিনুলের বিষয়ে কথা বলতে এসেছি শুনে শুধু হাসলেন। কিছু বলতে পারলেন না।
মায়ের এই হাসির জন্যই তো খেলেন মুমিনুল হক।
মুমিনুলের বাড়ি থেকে শেখ কামাল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম টমটমে মিনিট ১৫’র পথ। স্থানীয় পর্যায়ে তো এই মাঠে অনেকবারই খেলছেন মুমিনুল হক। একদিন আন্তর্জাতিক ম্যাচের জন্য গড়ে উঠবে সেই মাঠ। বাংলাদেশের জার্সি গায়ে নামবেন মুমিনুল হকও।
তখন হয়তো গ্যালারিতে পাওয়া যাবে বাবা নাজমুল হককে। যতই টেনশন হোক মুমিনুলের ঘরের মাঠ বলে কথা। আর টেনশন আবেগের সঙ্গে পেরেছে কবে??
সাক্ষাতকারটি সম্প্রতি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের সময় নেওয়া। সাক্ষাতকারের কিছু তথ্য ঘাটতি ছিল। সেসব তথ্য কক্সবাজারের পর্যটন সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে বাংলানিউজের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সেমিনার উপলক্ষে ৫ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত কক্সবাজারে অবস্থানকালে সংযুক্ত করে পুরোটা দেওয়া হলো।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৬
টিএইচ/আইএসএ/টিসি