ক্রিকেট সমরে বুক চিতিয়ে লড়া টাইগারদের সেই ওয়ানডে দলপতি, লাল-সবুজের ক্রিকেটের দিনবদলের মহানায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা বুধবার (২৬ জুলাই) এক একান্ত সাক্ষাতকার দেন বাংলানিউজের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট মহিবুর রহমানকে।
এ সময় তিনি অকপটে তুলে ধরেন নিজের অনাগত দিনের পরিকল্পনার কথা।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের আইকন মাশরাফির ক্রিকেটীয় ও ব্যক্তিগত জীবনের জানা ও অজানা অনেক কথার চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো বাংলানিউজ পাঠকদের জন্য।
বাংলানিউজ: গত কয়েকদিন জ্বরে ভুগেছেন, এখন শরীরের কী অবস্থা?
মাশরাফি: এখন ভালো। আস্তে আস্তে ভালো হচ্ছে।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচে’ সফল অধিনায়ক আপনি। এই বিষয়টি আপনাকে কতোটুকু আলোড়িত করে?
মাশরাফি: আমি সফল অধিনায়ক ঠিক আছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় সুমন ভাই (হাবিবুল বাশার) ভালো করেছেন, সাকিবও ভালো করেছে। ভালো করেছে মুশফিকও। এক এক পর্যায়ে গিয়ে এক একজন দলের হাল ধরেছেন। তবে আমারটুকু আমি সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেছি। যতোটুকু পেরেছি ততোটুকু নিয়েই আমি সবসময় খুশি থাকি এবং চেষ্টা থাকে সামনে আরো ভাল করার।
বাংলানিউজ: ক্রিকেট থেকে হয়তো একদিন আপনি বিদায় নেবেন। তার আগে আপনার এই জায়গায় আপনি কাকে রেখে যাচ্ছেন?
মাশরাফি: সবাই তো আছে। এখন বাংলাদেশের ক্রিকেট যে জায়গায় আছে, এখান থেকে দু’একটা সিরিজ খারাপ হতে পারে। এটা ভারতের হয়, প্রতিটি প্রতিষ্ঠিত দলেরও হচ্ছে। তবে এখন যেখানে চলে এসেছে, এখান থেকে, আমার মনে হয় বাংলাদেশের ক্রিকেট সামনেই এগিয়ে যাবে।
বাংলানিউজ: আরো কতো দিন খেলা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে?
মাশরাফি: দেখেন, কোন কিছুই তো আসলে গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় না। কালকে একটা ইনজুরি হতে পারে। যে কোন সমস্যা হতেই পারে। আবার সব কিছু ঠিকমত চলতে পারে। কোন কিছুই বলার উপায় নেই। তবে আমি যতোদিন খেলা উপভোগ করবো ততোদিনই খেলবো। সেটা কতোদিন এখনই বলতে পারছি না।
বাংলানিউজ: ২০১৯ বিশ্বকাপ নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
মাশরাফি: ওই যে বললাম, আমি যতোটুকু খেলাটাকে উপভোগ করবো ততটুকুই খেলবো। ওই পর্যন্ত আমি খেলবো কী না বা তার পরেও খেলবো কী না, এতো দূরের কথা কিছুই বলতে পারি না। বলিওনা, কারণ হল, ২০১১ বিশ্বকাপে এমন ঘটনা ঘটেছিল। তাই এসব নিয়ে কথা না বলাই ভাল।
বাংলানিউজ: আমরা আর পেছনে ফিরে না তাকাই। কামনা করি অমন কালো অধ্যায় আপনার জীবনে আর কখনোই না আসুক।
মাশরাফি: তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ। খেলতেই থাকবো। মৃদু হেসে পাল্টা প্রশ্ন, আর কিছু হলে?
বাংলানিউজ: নতুন যারা দলে আছে তাদের ভেতরে কতোটুকু সম্ভাবনা দেখছেন?
মাশরাফি: তারা সবাই ভালো খেলোয়াড়। এখন কথা হচ্ছে নিজেদেরকে ওরা কীভাবে তৈরি করবে, সেটা। ওদের ক্যারিয়ারের শুরুতে ওরা অনেক সফলতা পেয়েছে। তার মানে হচ্ছে এর থেকে আরো ভাল কিছু করার সামর্থ ওদের আছে। এখন দায়িত্বটা ওদেরই, নিজেদের আরো দায়িত্বশীল করে তোলা।
বাংলানিউজ: অবসরের পরেও ক্রিকেটের সাথে যুক্ত থাকার ইচ্ছে আছে?
মাশরাফি: এটা এখনই বলতে পারছি না। ক্রিকেটের সাথে থাকা না থাকা নিয়ে এখনো ভাবিনি। কারণ আমি যেভাবে থাকতে চাই সেভাবে থাকতে পারবো কী না জানি না। সময়ই বলে দেবে কী করবো।
বাংলানিউজ: আপনার যে জনপ্রিয়তা তাতে ভবিষ্যতে নিজেকে কি রাজনীতির মঞ্চে দেখতে চান?
মাশরাফি: অনেকেরই এমন মনে হয়েছে। আমি এর আগেও বলেছি, আমি কোন কিছুই পরিকল্পনা করে করি না। এই মুহূর্তে আমি খেলাটাকে উপভোগ করছি, তাই খেলে যেতে চাই। খেলা ছাড়ার পরে আমার ইচ্ছে আছে খেলার জগতে থাকা বা খেলার জন্য ভালো কিছু করা। কিন্তু সেগুলোও নির্ভর করছে, ওই সময়টা আমার কেমন যাবে তার উপর।
বাংলানিউজ: ক্রিকেটার না হলে কি হতেন?
মাশরাফি: ক্রিকেটার না হলে পড়ালেখা করতে হতো। চাকরি করতে হতো। আর সেটাও না হলে ব্যবসা করতে হতো। একটু থেমে বললেন, জীবন নিয়ে মানুষ যতো কিছু ভাবে আমি ওতো কিছু ভাবি না। কি হলে কি হতাম বা কাল কি হবে। আমার কাছে কথা হচ্ছে, প্রতিটি মুহূর্ত আমার ভাল গেলেই আমি খুশি। সেটা যে কোন কিছু করেই হোক।
বাংলানিউজ: ভক্তরা তো আপনার মাঝেই বাংলাদেশকে দেখতে পায়। বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
মাশরাফি: হাজার কষ্টের ভেতরেও দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি, এটা ঠিক। কারণ খেলাটাকে আমি অপরিসীম ভালোবেসেছি। আর খেলতে চেয়েছি, এইটাও ঠিক। কিন্তু মাশরাফি মানেই বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি এই বিষয়টাকে আমি ওইভাবে দেখি না। এই কারণে বাংলাদেশটা তো আসলে অনেক কিছুই বহন করে। দেশটা তো শুধু একজনকে দিয়ে বিবেচনা করা যায় না।
বাংলানিউজ: ক্রিকেট নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে ব্যস্ত থাকতে হয়। পরিবারকে সময় দেয়ার ফুসরত মেলে?
মাশরাফি: হ্যাঁ, অবসরে আমি আর কিছুই করি না। বাচ্চাদের সাথে থাকি। অনুশীলন শেষ করে ওদের সময় দেই। যতটুকু সময় পাই, বাইরে সময় নষ্ট করি না।
বাংলানিউজ: যখন মাশরাফি, সাকিব, তামিম, রিয়াদ, মুশফিক থাকবে না, তখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের অবস্থা কেমন হবে?
মাশরাফি: দেখবেন তখন আবার এমন ৫ জন দাঁড়িয়ে যাবে। এটা হচ্ছে একটা চলমান প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়েই আপনাকে সব সময় যেতে হবে। হয়তোবা একসাথে সবাই গেলে তখন দলের অবস্থা একটু কঠিন হয়ে যাবে। কিন্তু ওরা আরো ৫-৬ বছর ক্রিকেট খেলবে, আমি বাদে। সাকিব, তামিম, মুশফিক, রিয়াদের নুন্যতম পাঁচ থেকে ছয় বছর খেলার মতো সামর্থ্য আছে। ওইটা যদি ওরা খেলতে পারে, এর মধ্যে সৌম্য, মিরাজ, তাসকিন, মোস্তাফিজের ক্যারিয়ারের বয়স হয়ে যাবে ৮-৯ বছর। তখন ওরাই সিনিয়র হয়ে যাবে এবং দায়িত্ব নিতে শুরু করবে।
বাংলানিউজ: ২০১৫ বিশ্বকাপের বাংলাদেশের ক্রিকেটের যে অগ্রযাত্রা, এটা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ২০১৯ বিশ্বকাপের ফলাফল কেমন হতে পারে?
মাশরাফি: বিশ্বকাপ এমন একটা জায়গা, এখানে কোন কিছু আগে থেকে বলা যায় না। এখানে প্রথম যেটা লাগে সেটা হলো ভাগ্য। ভাগ্য ছাড়া বিশ্বকাপ জেতা সম্ভব না। ভালো ক্রিকেট অনেক দলই খেলে, কিন্তু বিশ্বকাপ জিততে পারে না। আমি মনে করি, ভাগ্যটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই কতো দূর যাবে এটা বলা যাচ্ছে না। তবে আমাদের অবশ্যই দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত চেষ্টা করতে হবে। এ কারণে বললাম, কোয়ার্টার ফাইনাল বা সেমিফাইনালে জেতা না জেতা নির্ভর করে নির্ধারিত দিনে কে কেমন খেলছে তার উপর। তবে সব সময়ই লক্ষ্য হওয়া উচিত, আমি যেনো দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত করতে পারি। তারপর অন্য কিছু।
বাংলানিউজ: আপনার অধীনে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল এবং চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল খেলেছে। কোনটি আপনার জন্য বিশেষ কিছু?
মাশরাফি: আমি বলবো দুটোই। ২০১৫ সালের কোয়ার্টার ফাইনাল আমাদের জন্য অনেক আনন্দের ছিল। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে আটটি দল খেলেছে, হয়তোবা সেরা আটটা-সেখানে সেমি ফাইনাল, এটাও আমার কাছে অন্যরকম আনন্দের। আমার কাছে আসলে ভাগাভাগি করার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ সময়: ০১২৪ ঘণ্টা, জুলাই ২৭ ২০১৭
এইচএল/জেডএম