ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

অদক্ষ চালকের হাতে নিয়ন্ত্রণহীন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা

সৈয়দ বাইজিদ ইমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৯ ঘণ্টা, মে ৫, ২০২৪
অদক্ষ চালকের হাতে নিয়ন্ত্রণহীন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ...

চট্টগ্রাম: কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বেপরোয়া গতির ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। প্রায়ই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা।

প্রথমদিকে নগরের বিভিন্ন অলি-গলিতে চলাচল করলেও এখন মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব অটোরিকশা। এতে একদিকে যেমন বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে কিশোর অপরাধ।

নগরের কল্পলোক আবাসিক এলাকা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই যুবক দলের আড্ডা। মোবাইলের আলোয় টাকার বিনিময়ে চলে লুড়ু খেলা। আরেকটু দূরে গিয়ে দেখা যায়, কিশোর-যুবকদের গাঁজা সেবনের আসর। তারা সবাই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক।  

শনিবার (৪ মে) দুপুর ২টা। নগরের এক্সেস রোডের মাথায় যুবক দলের জটলা। সামনে গিয়ে দেখা যায়, ভাড়া নিয়ে দ্বন্দ্বে এক যাত্রীকে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি মারছে পাঁচ থেকে ছয়জন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারা সবাই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। দিনের একবেলা অটোরিকশা চালায়, বাকি সময় নেশায় কাটায়। বিভিন্ন সময় ভাড়ায় রাজনৈতিক মিটিং-মিছিলেও যায় তারা।

তেমনই একজন রহিম উল্লাহ। বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে। এলাকায় মারামারি করে চট্টগ্রামে পালিয়ে এসেছে। এখন সে নগরের মুমিনবাগ আবাসিক এলাকার একটি কলোনিতে থাকে। সে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালায়। শুধু রহিম উল্লাহই নয়, বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ কর্মকাণ্ডের পর পালিয়ে এসে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালাচ্ছে অনেকে।  

কিছুদিন আগেও এসব অটোরিকশা অলি-গলি থেকে মূল সড়কে এলেই পুলিশ তাড়া করতো। সেই অটোরিকশা এখন মহাসড়কেও চলছে। অনেকে অটোরিকশার সামনে বেঁধে রাখছে ক্রাচ (যা বগলের নিচে রেখে ভর দিয়ে খোড়া লোকেরা চলাচল করে)। নগরে প্রায় ৩০ হাজার ব্যাটারি রিকশা চলাচল করছে। পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের টাকা দিয়ে তারা রাস্তায় নামে। প্রতিবন্ধী সেজে সহানুভূতি আদায় করে। অনেকে আবার টোকেন দিয়ে মহাসড়কে চালাচ্ছে এসব অবৈধ অটোরিকশা। যার কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা, যাচ্ছে প্রাণ।  

বাকলিয়া এক্সেস রোড নামে পরিচিত জানে আলম দোভাষ সড়কটি নগরের যানজট কমানোর পাশাপাশি দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে নগরের যোগাযোগ সহজ করার জন্য নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এ সড়কে এখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার জন্য অন্য গাড়ি চালানো দায়। সড়কের দুই প্রান্তে প্রতিনিয়ত ২০ থেকে ৩০টি অটোরিকশা জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এতে চকবাজার থেকে আন্দরকিল্লামুখি ও আন্দরকিল্লা থেকে চকবাজারমুখি গাড়িগুলো সবসময় যানজটের মুখোমুখি হচ্ছে। এছাড়া এসব অটোরিকশার চালকদের কারণে  স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়ছে বিড়ম্বনায়।  

অভিভাবকরা বলছেন, যে পরিমাণ বেপরোয়া গতিতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলো চলে তা দেখার যেন কেউ নেই। প্রায় সময় উঠতি বয়সী চালকরা মেয়েদের উত্যক্ত করে। এক্সেস রোডের দুই মুখে বিশেষ করে চকবাজারের দিকের মুখে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার কারণে যানজট লেগেই থাকে। এ সড়ক তৈরি করা হয়েছে যাতায়াতের সুবিধার জন্য। আর সেই সড়কই এখন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। রেহাই পাচ্ছে না গার্মেন্ট কর্মীরাও। পথ আগলে ধরে প্রেমের প্রস্তাবসহ নানাভাবে হয়রানি করছে তারা।

চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারী-নাজিরহাট মহাসড়কের মিরেরহাট সংলগ্ন বড়ুয়াপাড়া এলাকায় প্রাইভেটকার ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে মো. রফিক (৬০) নামে এক বৃদ্ধ নিহত হন। গত ১৯ মার্চ উপজেলা সদরের বাসস্টেশন এলাকায় বেপরোয়া গতিতে আসা মোটরসাইকেলের সঙ্গে অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই যাত্রী আহত হন। ১৪ এপ্রিল ফটিকছড়ি উপজেলার ঝংকার মোড়ে রাস্তা পারাপারের সময় চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস লেগে আহত হন এক কলেজ ছাত্রী। ২৭ মার্চ নগরের চকবাজার প্যারেড কর্ণারে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেলে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায় অটোরিকশা চালক। এতে মোটরসাইকেলের পেছনের অংশ দুমড়ে মুচড়ে যায়। আহত হন মোটরসাইকেলে থাকা রিজভী ও তার ভাগিনা আব্দুল্লাহ। প্রায়ই এরকম দুর্ঘটনায় অনেকে হতাহত হলেও রিকশাগুলো বন্ধে কোন ব্যবস্থা নেই।

বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ দিয়ে নগরের হামজারবাগ এলাকার বিভিন্ন স্থানে এসব অটোরিকশার চার্জ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু হামজারবাগই নয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন পাহাড়ি হাউজিং সোসাইটির রাস্তায় টিন শেড একটি কক্ষে অবৈধ সংযোগ থেকে ৪০ থেকে ৫০টি অটোরিকশার চার্জ দেওয়া হয়। সাধারণত একটি অটোরিকশা চালানোর জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন। প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৯০০ থেকে ১১০০ ওয়াট হিসেবে পাঁচ থেকে ছয় ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। ৮০ ভাগ গ্যারেজ মূল সংযোগ থেকে তার দিয়ে চুরি করে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়।  

জানা যায়, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, বায়েজিদ, খুলশী, কোতোয়ালি, পাহাড়তলী, হালিশহর, আকবরশাহ থানা এলাকায় বেশি চলে ব্যাটারিচালিত রিকশা। চান্দগাঁও  মৌলভীবাজার থেকে কালুরঘাট ব্রিজ এবং ওয়াসা রোড, পাঠাইন্না গোদা থেকে হামিদচর, ওসমানিয়াপুল থেকে সিএন্ডবি এর আশেপাশের এলাকায় ৩-৪ হাজার রিকশা চলাচল করে।  

বাকলিয়া থানাধীন এক্সেস রোড, চকবাজার ধুনিরপুল থেকে সৈয়দ শাহ রোড ও বড় কবরস্থান, পুলিশ বিট, আব্দুল লতিফ হাট থেকে চেয়ারম্যান ঘাট এবং আন্দরকিল্লা ও টেরিবাজার থেকে কালামিয়া বাজার পর্যন্ত ৫ হাজার রিকশা চলাচল করে। চকবাজার এলাকার ডিসি রোড, কে.বি আমান আলী রোড, নবাব সিরাজউদ্দৌলা রোড এবং এক্সেস রোডে চলাচল করে কয়েক হাজার ব্যাটারি রিকশা। খুলশী থানাধীন জালালাবাদ থেকে ওয়্যারলেস হয়ে সেগুনবাগান রেলওয়ে স্কুল, বিজিএমইএ ভবনের সামনে থেকে ঝাউতলা বাজার হয়ে আমবাগান রেলগেট, সাউদার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে পলিটেকনিক মোড় পর্যন্ত ২-৩ হাজার রিকশা চলাচল করে।  

বায়েজিদ জামশেদ শাহ মাজার রোড, কুলগাঁও আবাসিক এলাকা হতে খাজা রোড, অক্সিজেন মোড় থেকে আতুরার ডিপু, চন্দ্রনগর, আরেফিন নগর, বাংলা বাজার টেক্সটাইল মোড় ও হিলভিউ আবাসিক এলাকা, রৌফাবাদ কলোনি, বাংলাবাজার বশর কোম্পানির গ্যারেজ পর্যন্ত ৩-৪ হাজার ব্যাটারি রিকশা চলছে। হালিশহর ও পাহাড়তলী থানাধীন ফইল্যাতলী বাজার থেকে সবুজবাগ পেট্রোল পাম্পের মুখ, হালিশহর বি-ব্লক শাহজাহান বেকারি এলাকা, শারীরিক শিক্ষা কলেজ থেকে সাগরপাড়, আইয়ুব খানের গ্যারেজ থেকে পাহাড়তলী থানা এলাকার সাগরিকা রোড, বেপারিপাড়া কাসেম কোম্পানির গ্যারেজ হয়ে আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকার সড়কে ২ হাজারের অধিক ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে বলে জানা গেছে।  

প্রতিটি রিকশা থেকে গ্যারেজ মালিকরা চাঁদা বাবদ ১৫০-১৮০ টাকা আদায় করেন। এ টাকা গ্যারেজ মালিক, লাইনম্যান, নেতা ও পুলিশের মধ্যে ভাগ হয়। মালিকরা লাভবান হলেও ব্যাটারিচালিত রিকশায় চড়তে গিয়ে ঝুঁকিতে পড়ছেন যাত্রীরাই। হঠাৎ ব্রেক করলে ঘটছে দুর্ঘটনা।

সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। খুব শিগগিরই চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ এবং আমাদের সমন্বয়ে অভিযান পরিচালিত হবে।
২০১৪ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ২০১৭ সালে এসব পরিবহন বন্ধে আরেক দফা নির্দেশনা আসে। ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর অটোরিকশা বন্ধ ও আমদানি নিষিদ্ধ করেন সর্বোচ্চ আদালত।

ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধসহ ১৩ দফা দাবিতে চট্টগ্রামে সিএনজি অটোরিকশার মালিক ও চালকেরা সমাবেশ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। তারা সিটি মেয়র, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কমিশনার বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছিলেন।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, অবৈধ অটোরিকশা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৪ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০২৪
বিই/এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।