ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

নতুন বছরে ভারতের অর্থনৈতিক সঙ্কটই বড় চ্যালেঞ্জ

রক্তিম দাশ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১২
নতুন বছরে ভারতের অর্থনৈতিক সঙ্কটই বড় চ্যালেঞ্জ

কলকাতা: বিপুল অর্থনৈতিক সমস্যা কাঁধে নিয়েই শুরু হচ্ছে ভারতীয় অর্থনীতির নতুন বছর। বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কটের পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া ছাড়াও ভারতের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই অশনি সঙ্কেত দিচ্ছে।



স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং নতুন বছরের প্রাক্কালে অর্থনীতির হাল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে এই পরিস্থিতিকে আরও বেসরকারিকরণ, আরও বিদেশি পুঁজি-নির্ভর নীতি, আরও কর্পোরেটমুখী অভিমুখের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবহার করবে, এমন সম্ভাবনাই প্রবল।

অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার শ্লথ
২০১১ শুরু হয়েছিল দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৮ শতাংশ দিয়ে। এমনকি ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় বাজেটের আগে অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছিল ২০১১-১২ তে এর বৃদ্ধির হার ৯ শতাংশে পৌঁছে যাবে। কিন্তু সেই অত্যুৎসাহী পূর্বাভাস বেশিদিন টিকেনি।

জুনের শেষে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। এখন তা আরও কমে আসবে বলে আশঙ্কা। কেন্দ্রীয় সরকারও এখন স্বীকার করতে শুরু করেছে অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রেই বিকাশের হার খুবই উদ্বেগজনক।

শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির হার নেতিবাচক, এক বছরে তা ৫ শতাংশের বেশি কমে গেছে। কৃষিক্ষেত্রের বিকাশের হার ২-৩ শতাংশের বেশি হচ্ছে না দীর্ঘদিন ধরেই। শুধু পরিষেবা ক্ষেত্রের বিকাশে ভর করে অর্থনীতিকে গতিশীল রাখা যাবে না, এ কথা এখন বলতে শুরু করেছেন উদারনীতির পক্ষে সওয়ালকারীরাও।

রুপির দাম নিয়ে অনিশ্চয়তা
ভারতীয় রুপির দাম ২০১১-তে নিম্নতম স্তরে পৌঁছেছে। এক মার্কিন ডলারের দাম ১৫ ডিসেম্বর নেমে যায় ৫৪ রুপি ৩০ পয়সায়। তারপর কিছু বাড়লেও বছরের হিসাব ধরলে ১৬ শতাংশের বেশি কমেছে রুপির দাম। এশিয়ার সকল মুদ্রার মধ্যে ভারতের রুপির দামই সবচেয়ে বেশি কমেছে। রুপির দাম কমেছে একাধিক কারণে। এর মধ্যে বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ কমে যাওয়া অন্যতম প্রধান কারণ।

২০১০ সালের এপ্রিল-অক্টোবরে ২৭০০ কোটি ডলার ভারতে ঢুকেছিল। তা ২০১১ সালে কমে দাঁড়ায় মাত্র ৯২ কোটিতে। ইউরোপে আর্থিক সঙ্কট সমাধানের কোনও লক্ষণ চোখে না পড়ায় বিনিয়োগকারীরাও ঝুঁকি নিচ্ছেন না। অর্থনীতিবিদদের ধারণা আপাতত এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম।

বিদেশী বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে
এক সময়ে ভারতের মূলধনী বাজার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে পছন্দের হয়ে উঠলেও পরিস্থিতির বদল ঘটেছে। সেবি-র হিসেব অনুযায়ী ২০১১-তে বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক অর্থলগ্নী সংস্থাগুলি (এফ এফ আই) ভারতের বাজারে ৬ লাখ কোটি রুপির শেয়ার কিনেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিক্রি করেছে তার থেকে অনেক বেশি। তার ফলে ২৭০০ কোটি রুপি ভারত থেকে বেরিয়ে গেছে। ভারতের বাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লোকসানটাই বেশি হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

বিদায়ী বছরে এফ এফ আই-র ক্ষতির পরিমাণ ৬ লাখ কোটি রুপি বেশি। তবে এখনও ভারতের মূলধনী বাজারে বিদেশি লগ্নি পুঁজিই মুখ্য চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১২-তে একই প্রবণতা বজায় থাকবে। বিদেশি বিনিয়োগ ভারতে আনার মরিয়া চেষ্টাতেই খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। এই পথ সহজে ছেড়ে না দিয়ে নতুন বছরের কয়েক মাস পেরোলেই ফের সেই চেষ্টা করা হবে বলে ইতোমধ্যেই ইঙ্গিত মিলেছে।

ঋণ বাড়ছে
কেন্দ্রের আর্থিক অবস্থা বেহাল। মোট ৯৩ হাজার কোটি রুপি অতিরিক্ত ঋণ নিতে হচ্ছে বাজার থেকে। একদফায় প্রায় ৫৩ হাজার কোটি রুপি বাড়তি ঋণ নেওয়ার পর নতুন বছরের গোড়াতেই আবার বাজেট অনুমানের অনেক বাইরে গিয়ে ৪০ হাজার কোটি রুপি বাজার থেকে ধার করতে চলেছে সরকার। কেন্দ্রীয় বাজেটেই দু’দফায় ৪ লাখ কোটি রুপি ঋণ নেওয়ার কথা বলা ছিল। ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্বে আড়াই লাখ কোটি রুপি এবং অক্টোবর থেকে ২০১২ সালের মার্চ পর্যন্ত আরও ১ দশমিক ৬৭ লাখ কোটি রুপি বাজার থেকে ঋণ নেবে সরকার, এমনই অনুমান ছিল বাজেটে। সেই অনুমান বিপর্যস্ত।

সেপ্টেম্বরে নির্ধারিত হিসাবের বাইরে ৫২ হাচজার ৮৭২ কোটি রুপি ঋণ নিয়েছে কেন্দ্র। রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সুতরাং আবার ৪০ হাজার কোটি রুপি বন্ড ও অন্যান্য পদ্ধতিতে ঋণ নিতে বাধ্যই হচ্ছে সরকার। বাজেটের অনুমানের থেকে প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে কেন্দ্রকে। কেন্দ্রের অনুমিত কোষাগারীয় ঘাটতির থেকে অনেক বেশি ঘাটতি হবে চলতি আর্থিক বর্ষের শেষে। নভেম্বরেই অনুমিত ঘাটতির ৮৬ শতাংশে পৌঁছে গেছে কেন্দ্রের আয়-ব্যয়ের খতিয়ান। বাজেটে বলা হয়েছিল, পূর্ণ আর্থিক বর্ষে কোষাগারীয় ঘাটতি হবে ৪ কোটি ১২ লাখ ৮১৭ কোটি রুপি। নভেম্বরেই তা পৌঁছে গেছে ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৩৬৯ কোটি রুপি। বাজেটে এই ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।

এখন দেখা যাচ্ছে, তা ৬ শতাংশেরও বেশি হতে পারে। ঘাটতি সামলাতে কেন্দ্রের একটাই দাওয়াই: সামাজিক ক্ষেত্রে ভর্তুকি হ্রাস। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং নববর্ষের শুভেচ্ছা বার্তায় সেই ইঙ্গিত দিয়েই রেখেছেন। বিদ্যুতের মাসুল, পেট্রোপণ্যের দামের আরও বৃদ্ধি নিশ্চিত হয়ে উঠেছে। রাজধানীর রাজনৈতিক মহলের ধারণা, পাঁচ রাজ্যে ভোটের পরেই শুরু হবে ভর্তুকি ছাঁটাই এবং দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া। যদি উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের পর কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ হয়, তাহলে এ বছরের বাজেট হবে সরকারের ব্যয় কমানোর বাজেট।

কর্মসংস্থানের হার কমছে
অর্থনৈতিক বিকাশের হার যাই হোক না কেন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কোনও চিহ্নই নজরে পড়ছে না। বছর শেষের মুখেই শিল্পক্ষেত্রের বার্ষিক সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এই রিপোর্ট ২০০৯-১০ হিসেবের ভিত্তিতে। দেখা যাচ্ছে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার নেমে এসেছে ৪ দশমিক ১১ শতাংশে। তার আগের বছরই এই হার ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এটি উৎপাদন ক্ষেত্রের হিসাব।

সদ্য প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার পাঁচ বছরের রিপোর্টও। দেখা যাচ্ছে চাঞ্চল্যকরভাবে কমে গেছে বার্ষিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার। আগের পাঁচ বছরে যা ছিল ২ দশমিক ৭ শতাংশ, তা গত পাঁচ বছরে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ০ দশমিক ৮ শতাংশ। দু’টি হিসাব পাশাপাশি রাখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশে কর্মসংস্থানহীন বৃদ্ধির ঘটনাই ঘটছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে কিছু কর্মসংস্থান তৈরি হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাজ ছাঁটাইয়েরই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

বস্ত্র, অলঙ্কার, পোশাক, ধাতব শিল্পে বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কটের সরাসরি প্রভাবও পড়েছে। রপ্তানি কমে গিয়ে কাজ হারিয়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। নিয়োগের চরিত্রেও গুরুতর পরিবর্তন ঘটে গেছে। কর্পোরেট মহলের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে শ্রম আইন আরও শিথিল করতে হবে। নতুন বছরে কেন্দ্রীয় সরকার সে পথে হাঁটার চেষ্টা করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

মৃল্যবৃদ্ধি ব্যাপকতা
মূল্যবৃদ্ধির হার ডিসেম্বরের শেষের দিকে খানিকটা কমেছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার গত কয়েক বছরের তুলনায় গত ১৫ দিন অনেকটাই কম। কিন্তু এমনকি কেন্দ্রের নীতি নির্ধারক মহলেও এ নিয়ে তেমন উৎসাহ নেই। এই হার আবার বাড়তে শুরু করবে বলেই মনে করা হচ্ছে। ২০১০ সালের মার্চ থেকে মোট ১৩ বার রিজার্ভ ব্যাংক সরাসরি সুদের হার বা রেপো রেটের পরিবর্তন করেও মুদ্রাস্ফীতিকে তেমন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের তেমন কোনও চেষ্টা সরকারের তরফ থেকে হয়নি।

অর্থনীতিবিদদের অনেকেরই বক্তব্য, এই অবস্থা তিন-চার বছর ধরে চলতে থাকায় এই খারাপ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। বার বারই সরকারের কাছ থেকে মরসুমের দোহাই পাড়া হয়েছে অথবা উৎপাদন বৃদ্ধি হলেই দাম কমে যাবে এই মর্মে আশ্বাসবাক্য শোনানো হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির ফলে গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত আয় কমছে।

এই স্তরে মজুরি বৃদ্ধির হার খুবই কম, এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে অনড় হওয়ায় দেশের বিপুল অংশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। তা আবার বিক্রির বাজারে গুরুতর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে বলে অর্থনীতিবিদদের ধারণা। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই সরকারের কাছে এখন এক নম্বর চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।