প্রশ্ন: বহুজাতিক কম্পানিতে বাংলাদেশি নেতৃত্বের আপনি নিজে একটি বড় উদাহরণ। এখানকার পেশাজীবীদের দক্ষতা ও সম্ভাবনাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
উত্তর: একটা সময় বাংলাদেশি মাল্টিন্যাশনালে বাংলাদেশি সিইও ছিল না।
সেই ট্যালেন্ট, পটেনশিয়াল—সবই আমাদের আছে। বিশ্বের বড় বড় বহুজাতিক কম্পানির গ্লোবাল সিইও হিসেবে ভারতীয়রা কাজ করছেন। আমরা এখনো হয়তো সে পর্যায়ে যেতে পারিনি; কিন্তু এক প্রজন্ম পরে আমরাও সেই জায়গায় যেতে পারব বলে আশা করি। আমাদের প্রজন্মে বাংলাদেশের সিইও হয়েছি, পরের প্রজন্ম হয়তো গ্লোবাল সিইও হবে।
আমার আশা থাকবে, বাংলাদেশিরাই হবে ইউনিলিভারের গ্লোবাল সিইও। শুধু তা-ই নয়, মাইক্রোসফট, প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল, গুগল, অ্যাপলের মতো কম্পানিতেও বাংলাদেশিরা সাফল্যের স্বাক্ষর রাখবেন।
প্রশ্ন: বহুজাতিক কম্পানির সাফল্যের পেছনে কী আছে, যা দেশীয় কম্পানিগুলোতে অনুপস্থিত?
উত্তর: বহুজাতিক কম্পানি মূলত একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হয়। আমি থাকি বা না থাকি, কম্পানি চলবে; কারণ এর একটি শক্তিশালী প্রসেস রয়েছে।
করপোরেট সংস্কৃতি এখানকার বড় শক্তি, যা দেশীয় কম্পানিতে আরো জোরদার করতে হবে। আমার মূল কাজ হলো আমার সহকর্মীদের ইস্যুগুলো চিহ্নিত করা, প্রয়োজনীয় রিসোর্স উন্মুক্ত করা। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ম্যানেজাররাই আছেন। একজন লিডারের দায়িত্ব হলো সুযোগ সৃষ্টি করা। দিনের শেষে যদি পুরো টিম ভ্যালু তৈরি করতে পারে, সেটাই বড় অর্জন। আমাদের দেশীয় কম্পানিগুলোকে করপোরেট সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করতে হবে। এরই মধ্যে কিছু স্থানীয় কম্পানি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের মতো করপোরেট কালচার লালন করছে।
প্রশ্ন: উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে স্থানীয় কম্পানির কী ঘাটতি দেখেন?
উত্তর: দেশীয় অনেক কম্পানি ভালো ভালো উদ্ভাবন নিয়ে আসছে। তারা অনেক ভালো প্রোডাক্ট তৈরি করছে। ধীরে ধীরে আরো বাড়বে। আমাদের দেশীয় কম্পানিতে অনেক সৃষ্টিশীল পেশাজীবী আছেন। ভবিষ্যতে আরো আসবে। দেশীয় কম্পানিগুলো আরো ভালো করবে।
প্রশ্ন: বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত গতিতে বাড়ছে না কেন?
উত্তর: এ দেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনার অভাব নেই। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রক্রিয়াগত। বিনিয়োগ আনতে গেলে অনেকগুলো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। দুবাইতে আমি ১৫ মিনিটে কম্পানি তৈরি করে ফেলতে পারি; সিঙ্গাপুরে পারি এক সপ্তাহের মধ্যে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ আনতে একটি কম্পানির অনেক ক্ষেত্রে বছর পার হয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান, এনবিআর চেয়ারম্যান—তাঁরা চেষ্টা করছেন। কিন্তু এটা যখন নিজে অপারেশনসে যায় তখন তা দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে যায়। এসব ক্ষেত্রেও আমাদের সংস্কার করতে হবে।
প্রশ্ন: ইউনিলিভার, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, শেভরনের মতো ব্র্যান্ড থাকার পরও বিদেশি বিনিয়োগ সেভাবে বাড়ছে না। অথচ বাংলাদেশের চেয়ে ছোট অর্থনীতিও বেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে। কেন?
উত্তর: এর অন্যতম হলো উচ্চ করহার; একজন বিনিয়োগকারী ভিয়েতনামের মতো দেশে কম কার্যকর করহার পেলে স্বভাবতই সেখানে বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকবেন। লভ্যাংশ প্রত্যাবাসনের জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়াও একটি বড় বাধা, কারণ এটি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করে। এ ছাড়া আমাদের কাস্টমস ব্যবস্থা বাণিজ্য সহজ করার পরিবর্তে কর আদায়ের ওপর বেশি জোর দেয়, যা পণ্য খালাস প্রক্রিয়াকে ধীর করে তোলে। এসবই মূলত বাংলাদেশে এফডিআই বাড়ার পথে বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রশ্ন: আপনারা ফিকি থেকে বলছেন, সরকারও জানে সমস্যা কোথায়, তাহলে সমাধান কেন আসে না?
উত্তর: সমাধান করতে হলে কিছু অপ্রিয় কিন্তু জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবকিছুর ডিজিটাইজেশন করাটা এমন কোনো অসম্ভব কাজ নয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বিদেশি কম্পানিগুলো যখন লভ্যাংশ বা রয়ালটি নিজ দেশে ফেরত নিতে চায়, তখন তাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। এই ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা বিদেশি বিনিয়োগকে পিছিয়ে দেয়। যদিও বর্তমান বিডা চেয়ারম্যান এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন।
প্রশ্ন: তার মানে, সমস্যার সমাধান না হলে বিদেশি বিনিয়োগ আসা কঠিন?
উত্তর: আপনার পর্যবেক্ষণ একদম সঠিক। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন হাফ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি, যা অনেক দেশের চেয়ে বড়। এমন একটি বিশাল বাজারে সুযোগের অভাব নেই। কিন্তু প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল বা হেনকেলের মতো আরো অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এখানে নেই। এর কারণ হলো আমাদের নিজেদের তৈরি করা কিছু বড় প্রতিবন্ধকতা। আমরা নিজেরাই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য এমন কিছু পরিবেশ তৈরি করেছি, যা তাদের নিরুৎসাহ করে।
প্রশ্ন: বিদেশি বিনিয়োগ আনা এবং তা ধরে রাখার ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী?
উত্তর: বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের বড় সুযোগ রয়েছে, বিশেষ করে এর বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার এবং রপ্তানি সক্ষমতার কারণে, যা আমরা তৈরি পোশাক খাতে প্রমাণ করেছি। তবে এখানে বিনিয়োগের পরিবেশটি এখনো সহজ নয়। একজন বিনিয়োগকারীকে অনেক ধৈর্য ধরতে হয় এবং অসংখ্য অনুমোদনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে এসে একজন বিদেশি প্রায়ই বিডা, বেজা, বেপজা, ইপিবির মতো বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম সম্পর্কে বিভ্রান্ত হন। এই প্রক্রিয়া সহজ করতে সবগুলোকে একটি একক প্ল্যাটফর্মে আনা জরুরি।
প্রশ্ন: অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন সংস্কার করছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারের পদক্ষেপ কেমন হওয়া উচিত?
উত্তর: একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী যখন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তাঁদের মনে প্রথমে কি বাংলাদেশের নাম আসে? তিনি হয়তো প্রথমে চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়ার কথা ভাবেন। বাংলাদেশ যে একটা বিনিয়োগের আকর্ষণীয় গন্তব্য, সেটা আগে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমরা যদি তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে পারি, তাহলে অন্যান্য ক্ষেত্রে কেন পারব না। আমরা কেবল দুনিয়ার দর্জি নয়, আমরা অনেক কিছু বানাতে পারি। বাংলাদেশকে একটি উন্নতমানের দক্ষতানির্ভর ম্যানুফ্যাকচারিং হাবে পরিণত করতে হবে। সবাই মিলে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে হবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের কি ইতিবাচক পরিবর্তন দেখছেন?
উত্তর: দেশে বিনিয়োগ সহজ করতে বিডার কাজগুলো পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। কাস্টমসের কাজ শুল্ক আদায় নয়, ব্যবসাকে ফ্যাসিলিটেট করা। তাড়াতাড়ি পণ্য খালাস করা। আমরা যে কনটেইনার খালাস করছি, সেটা প্রক্রিয়াগত সহজীকরণে যদি দ্বিগুণ করা যায় তাহলে কর আদায় এমনিতেই বাড়বে। তবে বিডা, বিএসইসিসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর আরো বোল্ড রিফর্ম করা উচিত।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
উত্তর: চ্যালেঞ্জ থাকলেও আমি আশাবাদী। সংস্কার, উদ্ভাবন ও মানবসম্পদের উন্নয়নে গুরুত্ব দিলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ
এনডি