ঢাকা, সোমবার, ২৪ ভাদ্র ১৪৩২, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

অর্থনীতি-ব্যবসা

ডিজিটাল ব্যাংক: টেকসই আর্থিক অন্তর্ভুক্তির নতুন দিগন্ত

মো. ইকবাল হোসেন চৌধুরী | সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন
আপডেট: ০৮:৪৪, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৫
ডিজিটাল ব্যাংক: টেকসই আর্থিক অন্তর্ভুক্তির নতুন দিগন্ত মো. ইকবাল হোসেন চৌধুরী

বাংলাদেশের আর্থিক খাত গত এক যুগে মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) কারণে এক নতুন বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। বিকাশ, নগদ, রকেটসহ বিভিন্ন এমএফএস প্রতিষ্ঠান লাখ লাখ মানুষকে ডিজিটাল লেনদেনের স্বাদ দিয়েছে।

কিন্তু এখানেই থেমে থাকা সম্ভব নয়। বিশ্ব এগোচ্ছে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থার দিকে, যেখানে গ্রাহকরা শুধু টাকা পাঠানো বা বিল পরিশোধ নয়, বরং আমানত রাখা, ঋণ গ্রহণ, আন্তর্জাতিক রেমিট্যান্স এবং বিনিয়োগের মতো সেবা মোবাইল ফোন থেকেই করতে পারেন। সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংক আবারও নতুন করে ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে।

নতুন লাইসেন্স নীতি ও মূলধনের শর্ত: ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকের নীতিমালা প্রণয়ন করে। তখন ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন ছিল ১২৫ কোটি টাকা। তবে সম্প্রতি নতুন প্রজ্ঞাপনে সেই সীমা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। উদ্দেশ্য হলো আর্থিকভাবে সক্ষম প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আনা এবং দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছেঁটে ফেলা। প্রচলিত ব্যাংকের জন্য ন্যূনতম মূলধন যেখানে ৫০০ কোটি টাকা, সেখানে ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য ৩০০ কোটি টাকার শর্ত মাঝামাঝি একটি অবস্থান তৈরি করেছে। এবারের উদ্যোগে আর্থিক সক্ষমতার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। কারণ শাখাবিহীন ও অ্যাপভিত্তিক ব্যাংক চালাতে শক্তিশালী প্রযুক্তি অবকাঠামো অপরিহার্য।

বিতর্কিত প্রথম ধাপ: প্রথমবার লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়ায় ৫২টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছিল। এর মধ্যে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান এলওআই  (লেটার অব ইনটেন্ট) পায় এবং নগদ ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স নানা অভিযোগে স্থগিত হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানায়, রাজনৈতিক প্রভাব, আর্থিক অনিয়ম ও জালিয়াতির মতো গুরুতর অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে ছিল। অপরদিকে কড়ি ডিজিটাল ব্যাংক এখনো অনুমোদন পায়নি। এ প্রক্রিয়াকে ঘিরে ব্যাপক সমালোচনা ওঠে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) স্পষ্ট ভাষায় বলে, লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে দুর্নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও স্বচ্ছতার অভাব ছিল। তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, এই প্রক্রিয়া উদ্ভাবনকে নিরুৎসাহিত করেছে এবং নতুন উদ্যোক্তাদের পথে বাধা তৈরি করেছে। ফলস্বরূপ, ডিজিটাল ব্যাংকিং যাত্রার প্রাথমিক ধাপেই আস্থার সংকট তৈরি হয়।

কেন ডিজিটাল ব্যাংক অপরিহার্য: বাংলাদেশে এখনো বিপুল জনগোষ্ঠী ব্যাংকিংসুবিধার বাইরে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার একটি বড় অংশের কোনো ব্যাংক হিসাব নেই। এর কারণ প্রচলিত ব্যাংকের শাখা ও জনবলভিত্তিক পরিচালন ব্যয় অনেক বেশি। বিশেষ করে প্রত্যন্ত ও দুর্গম গ্রামীণ এলাকায় ব্যাংক স্থাপন আর্থিকভাবে লাভজনক নয়। ডিজিটাল ব্যাংক এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারে। এগুলো; ২৪/৭ সেবা : গ্রাহকরা যে কোনো সময় মোবাইল অ্যাপ বা ওয়েবসাইট থেকে সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা নিতে পারবে। অফিসবিহীন মডেল : কোনো শাখা বা উপশাখার প্রয়োজন নেই। ফলে ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা থাকবে না।

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন: ছোট ব্যবসায়ী বা স্টার্টআপ উদ্যোক্তারা সহজেই ক্ষুদ্র ঋণ পেতে পারবেন।

প্রবাসী আয়ের সহজীকরণ: বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্স সরাসরি ডিজিটাল ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : দরিদ্র ও ব্যাংকবহির্ভূত জনগোষ্ঠীও ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসবে।

বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা: ডিজিটাল ব্যাংক কোনো ভবিষ্যৎ কল্পনা নয়, এটি ইতোমধ্যেই বৈশ্বিকভাবে সফল একটি বাস্তবতা। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে চার শতাধিক ডিজিটাল ব্যাংক সক্রিয় রয়েছে।

রেভোলুট (যুক্তরাজ্য): মাল্টি-কারেন্সি অ্যাকাউন্ট, আন্তর্জাতিক রেমিট্যান্স ও বিনিয়োগ সেবার কারণে ইউরোপজুড়ে জনপ্রিয়।

এন২৬ (জার্মানি): ব্যবহারবান্ধব মোবাইল অ্যাপ ও ফি-বিহীন অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের কাছে বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য।

নিউব্যাংক (ব্রাজিল): ক্ষুদ্র ঋণ ও সাশ্রয়ী ক্রেডিট কার্ড সুবিধা দিয়ে কোটি মানুষের আস্থা অর্জন করেছে।

ভারত ও পাকিস্তান: প্রতিবেশী দেশগুলো ইতোমধ্যেই ডিজিটাল ব্যাংক চালু করেছে এবং দ্রুত গ্রাহক অর্জন করছে। এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যে উন্নত অবকাঠামো ও স্বচ্ছ নীতি থাকলে ডিজিটাল ব্যাংক কয়েক বছরের মধ্যেই কোটি গ্রাহককে সেবা দিতে সক্ষম হয়।

সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ: বাংলাদেশের জন্য ডিজিটাল ব্যাংক চালু করা যতটা সম্ভাবনাময়, ততটাই চ্যালেঞ্জপূর্ণ। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা : প্রথম দফার অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, লাইসেন্সিংয়ে রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতি বড় বাধা। দ্বিতীয় দফায় এ ভুল হলে আস্থা পুনরুদ্ধার করা কঠিন হবে। প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা : সাইবার হামলা, জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের ঝুঁকি থেকে গ্রাহককে সুরক্ষিত রাখতে উন্নত এনক্রিপশন, বায়োমেট্রিক যাচাইকরণ ও মাল্টি-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন বাধ্যতামূলক করতে হবে।

গ্রাহক আস্থা: ব্যাংকিং খাতে গ্রাহকের আস্থা সবচেয়ে বড় সম্পদ। দ্রুত, নিরবচ্ছিন্ন ও স্বচ্ছ সেবা নিশ্চিত না করতে পারলে মানুষ ডিজিটাল ব্যাংকের দিকে ঝুঁকবে না।

নিয়ন্ত্রক কাঠামো: নতুন করে পাস হওয়া ‘পরিশোধ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থা আইন, ২০২৪’ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা জরুরি। নীতিশূন্যতা থাকলে ডিজিটাল ব্যাংকের কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা : এখনো গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ দুর্বল। ডিজিটাল ব্যাংক সফল করতে হলে সবার আগে শক্তিশালী আইসিটি অবকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে।

নীতিনির্ধারকদের জন্য করণীয়: লাইসেন্স প্রদানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। শক্তিশালী সাইবার নিরাপত্তাকাঠামো গড়ে তোলা। গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় ফি ও চার্জ নিয়ন্ত্রণ করা। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করা। পাঁচ বছরের মধ্যে আইপিও বাধ্যতামূলক করার শর্ত কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা, যাতে ব্যাংকগুলো জনসাধারণের কাছে জবাবদিহি হয়। বাংলাদেশে প্রযুক্তি-সচেতন তরুণ প্রজন্ম, স্মার্টফোনের ব্যাপক ব্যবহার, ইন্টারনেট কভারেজ ও ক্রমবর্ধমান মোবাইল পেমেন্ট ইকোসিস্টেম ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। কিন্তু সফল হতে হলে নীতিনির্ধারকদের দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বচ্ছতা, প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা ও গ্রাহক আস্থা নিশ্চিত করা গেলে ডিজিটাল ব্যাংক শুধু একটি ব্যাংকিং মডেল নয়, বরং টেকসই আর্থিক অন্তর্ভুক্তির নতুন দিগন্ত হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের সামনে এখন সুযোগ ডিজিটাল ব্যাংকের মাধ্যমে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন থাকলে এই উদ্যোগ লাখো মানুষের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে এবং দেশকে প্রকৃত অর্থে ক্যাশলেস অর্থনীতির পথে নিয়ে যাবে।
 
লেখক: পরিচালক বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, বেঙ্গল ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স ও কর্ণধার জেসিএক্স গ্রুপ

এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।