ঢাকা, শুক্রবার, ২৭ ভাদ্র ১৪৩২, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

অর্থনীতি-ব্যবসা

স্টার্টআপ ব্যবসায় এগিয়ে নিতে নীতি সহায়তা বাড়ানো-নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকা প্রয়োজন

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৩৪, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৫
স্টার্টআপ ব্যবসায় এগিয়ে নিতে নীতি সহায়তা বাড়ানো-নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকা প্রয়োজন

ঢাকা: দেশের তরুণ উদ্যোক্তা, উদ্ভাবক ও ফ্রিল্যান্সাররা বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছেন। তবে এ প্রচেষ্টার পথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে যার মধ্যে আছে স্টার্টআপের জন্য পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব ও উপযুক্ত নীতিগত সহায়তার সীমাবদ্ধতা।

এ স্টার্টআপের দেশের প্রায় ৩ কোটি তরুণ প্রজন্মকে নিজেদের সম্ভাবনা উপলব্ধি করার সুযোগ দেয় এবং দেশকে একটি উন্নত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে এ খাতকে শক্তিশালী করা অপরিহার্য বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তি, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), দ্রুত বদলে দিচ্ছে অর্থনীতির চালচিত্র। এ পরিবর্তনের ঢেউ বাংলাদেশেও পৌঁছেছে। দেশে স্টার্টআপ ব্যবসা এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগটি সময়োপযোগী। এজন্য এ খাতে নীতি সহায়তা বাড়ানোর পাশাপাশি একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকা প্রয়োজন।

সম্প্রতি বাংলাদেশে স্টার্টআপ ক্যাপিটাল, এআই প্রযুক্তি ফ্রিল্যান্সারদের জন্য নীতি সহায়তা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ ডিজিটাল অর্থনীতির নানা বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছিলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ডা. জাহিদ হোসেন, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন এবং আসন্ন এফবিসিসিআই নির্বাচনে সহসভাপতি প্রার্থী ও ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাকিফ শামীম।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, একটি স্টার্টআপ ব্যবসার সাফল্যের জন্য তহবিল গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উদ্ভাবনী ব্যবসা উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তিনি মনে করেন, ভালো ধারণা এবং কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত মূলধন জোগাড় করতে না পারলে অনেক সম্ভাবনাময় উদ্যোগও মাঝপথে থেমে যেতে পারে। এজন্য স্টার্টআপগুলোর জন্য পর্যাপ্ত তহবিল নিশ্চিত করা জরুরি, যা তাদের নতুন উদ্ভাবনে উৎসাহিত করবে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।

এ তহবিল মূলত বিভিন্ন খাতে ব্যবহৃত হয়, যেমন- পণ্যের উন্নয়ন, বাজার গবেষণা ও বিপণন, কর্মচারী নিয়োগ ও অপারেশনাল খরচ ইত্যাদি।  

ড. জাহিদ হোসেন কয়েকটি সম্ভাব্য উৎসের কথা উল্লেখ করেছেন যা থেকে স্টার্টআপগুলো তহবিল সংগ্রহ করতে পারে যেমন- নিজস্ব সঞ্চয়, পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ, অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর বা ধনী ব্যক্তি যারা তাদের ব্যক্তিগত অর্থ নতুন ও সম্ভাবনাময় স্টার্টআপে বিনিয়োগ করেন। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্মগুলো বড় অংকের বিনিয়োগ করে, তবে তারা সাধারণত তুলনামূলকভাবে প্রতিষ্ঠিত বা দ্রুত বর্ধনশীল স্টার্টআপে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয় এছাড়া রয়েছে ব্যাংক ঋণ।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, প্রতিটি স্টার্টআপের উচিত তাদের ব্যবসার ধরন এবং লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তহবিল সংগ্রহের সঠিক কৌশলটি খুঁজে বের করা। সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর বাস্তবায়ন একটি স্টার্টআপকে সফলতার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে একটি স্টার্টআপের সফলতার হার আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অনেক কম, যার একটি বড় কারণ হলো ফান্ডিং গ্যাপ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার ও বেসরকারি খাতকে একযোগে কাজ করতে হবে। সরকারি প্রণোদনা, কর সুবিধা এবং সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা স্টার্টআপদের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্মগুলোকে আরও সক্রিয় করতে নীতি সহায়তা দেওয়া জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, ভারত ও সিঙ্গাপুরে সরকারি উদ্যোগে গঠিত তহবিলের মাধ্যমে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে শক্তিশালী করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন একটি মডেল অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে।

 এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী নেতা ও আসন্ন এফবিসিসিআই নির্বাচনে সহ-সভাপতি প্রার্থী  সাকিফ শামীম বলেন, যেকোনো উদ্ভাবনী উদ্যোগের প্রাণশক্তি হলো স্টার্টআপ ক্যাপিটাল, বা প্রারম্ভিক মূলধন। বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজারো নতুন স্টার্টআপ যাত্রা শুরু করলেও, তাদের অধিকাংশই পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে অঙ্কুরেই ঝরে পড়ে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (ভিসি) এবং অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টরদের সংখ্যা হাতেগোনা, এবং বিনিয়োগের প্রক্রিয়া প্রায়শই জটিল। স্টার্টআপের জন্য পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব, এআই-ভিত্তিক পণ্য রপ্তানিতে নানা জটিলতা এবং ফ্রিল্যান্সারদের জন্য উপযুক্ত নীতিগত সহায়তার সীমাবদ্ধতা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে এবং একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে এই তিনটি ক্ষেত্রকে সমন্বিতভাবে শক্তিশালী করা অপরিহার্য। স্টার্ট আপ ব্যবসা সঠিকভাবে পরিচালনায় একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকা খুব প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি খাতের সমন্বিত উদ্যোগে একটি প্লাটফর্ম গড়ে তোলতে হবে।

তিনি বলেন, স্টার্টআপ ক্যাপিটাল, এআই প্রযুক্তি ও ফ্রিল্যান্সারদের জন্য নীতিগত সহায়তা-এ তিনটি ক্ষেত্র একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি শক্তিশালী স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম নতুন এআই-ভিত্তিক উদ্যোগকে উৎসাহিত করবে, যা ফ্রিল্যান্সারদের জন্য নতুন কাজের সুযোগ তৈরি করবে। অন্যদিকে, দক্ষ ফ্রিল্যান্সাররা স্টার্টআপগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ সরবরাহ করবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এই তিনটি স্তম্ভের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। একটি সুদূরপ্রসারী ও সমন্বিত নীতিমালার মাধ্যমে এই ক্ষেত্রগুলোকে শক্তিশালী করা গেলে আমরা কেবল একটি স্মার্ট বাংলাদেশই নয়, বরং একটি টেকসই, উদ্ভাবনী এবং বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায় সক্ষম জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারব।

জানা গেছে, স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়ন সমস্যার সমাধানে এ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন এ কোম্পানি গঠন করা হলে তাতে ৬৫০ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মিলে। এছাড়া ৪ শতাংশ সুদে সর্বোচ্চ ৮ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবেন একজন স্টার্টআপ উদ্যোক্তা। এরই মধ্যে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে সম্প্রতি কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে সভা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সভায় আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে কোম্পানি গঠন করে কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে মত দিয়েছে বেশির ভাগ ব্যাংক।

এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, আমরা স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, তবে সেটা খুব বেশি সফল হয়নি। এখন নতুন নতুন খাতে অভিনব উদ্যোগ আসছে। বিশেষ করে কৃষি ও প্রযুক্তি খাতে। ব্যাংক থেকে ঋণ দিতে গেলে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়, এ জন্য অনেক স্টার্টআপ উদ্যোক্তা ঋণ পান না। এ জন্য ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি গঠন করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত তহবিলের ৬৫০ কোটি টাকা হবে এ প্রতিষ্ঠানের মূলধন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি চার ব্যাংকের প্রতিনিধি এ প্রতিষ্ঠানের পর্ষদে থাকবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে হবে কোম্পানিটির কার্যালয়। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া হবে না। যারা অভিনব উদ্যোগ নিয়ে আসবেন, তাদের প্রকল্পে মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ করা হবে। কখনো মুনাফায় গেলে তখন সে উদ্যোগ থেকে বের হয়ে আসবে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল। এটাই বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত পন্থা। আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি গঠন হয়ে যাবে। এরপর উদ্যোক্তারা এ প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিয়োগ পাবে।

জিসিজি/জেএইচ


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।