২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোতে (এনজিও) বৈদেশিক অনুদান এসেছে রেকর্ড ৯ হাজার ২২০ কোটি টাকা। গত ২৫ বছরে মোট বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ২২১ কোটি টাকা।
সরকারের এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে মিয়ানমারে জোরপূর্বক বাস্তচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য বিদেশি সহায়তা শুরুর আগ পর্যন্ত বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ ছিল প্রতি বছর সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার নিচে। ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরের আগে এই পরিমাণ আরও কম ছিল, দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার নিচে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়তা আসা শুরু হলে এনজিওর মাধ্যমে আসা সহায়তা প্রতি বছরই বেড়েছে। অন্যান্য খাতের সহায়তা বৃদ্ধিসহ ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে সর্বোচ্চ অনুদান এসেছে।
তবে বেসরকারির উন্নয়ন সংস্থাগুলো থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আলোচনায় আসার প্রেক্ষাপটে দাতা সংস্থাগুলো হাত গুটিয়ে নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। এ সহায়তা চলে যাচ্ছে দারিদ্র্যপীড়িত, দুর্যোগ-দুর্ভিক্ষ প্রবণ ও যুদ্ধ-বিগ্রগের মধ্যে থাকা দেশগুলোতে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়তা যোগ হওয়ার কারণে সহায়তার পরিমাণ বেশি মনে হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে এনজিওর মাধ্যমে সহায়তার পরিমাণ কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বড় একটি সংস্থার সহায়তা বন্ধ করে দিলে আরও কমছে। বৈদেশিক সহায়তা দেশে আসার ক্ষেত্রে দাতা দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি ও প্রকল্পের সংখ্যাতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। এটি আরও স্পষ্ট হবে চলতি অর্থবছরের সহায়তার হিসাবে।
তথ্য বলছে, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে প্রকল্প অনুমোদন হয় ১ হাজার ৮৩৬টি। তার আগের বছর কিছুটা কম থাকলেও তারও আগের তিন বছরের প্রতি বছর দুই হাজারের বেশি করে প্রকল্প অনুমোদন পায়। প্রকল্প হ্রাসের নিম্নমুখী ধারাটি চলতি বছরের জুলাই মাসেও অব্যাহত আছে। বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রতিশ্রুতি পায় ১৪৫টি প্রকল্প।
২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে দাতারা প্রতিশ্রুতি দেয় ৯ হাজার ২০৬ কোটি টাকা; ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ছিল ৯ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা; ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৭ হাজার ২০৩ কোটি টাকা এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দাতাদের প্রতিশ্রুতি ছিল ৮ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা।
বৈদেশিক সহায়তা কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে অনেক এনজিওকে কার্যক্রম কমিয়ে আনতে হয়েছে। কর্মী কমিয়ে আনতে হয়েছে। এ অবস্থায় টিকে থাকতে কোনো কোনো এনজিও বিকল্প খুঁজছে। কেউ সরকারি সোর্সের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। কোনো কোনো এনজিও এখনো যেসব দেশ ও দাতা সংস্থা থেকে সহায়তা নেয়নি, সেসব দেশের দিকে মনোনিবেশ করেছে।
জানা গেছে, দেশের বড় এনজিও ব্র্যাকের সহায়তা কর্মসূচির মোট ব্যয়ের ৮০ ভাগ চলে আড়ং-এর মুনাফা থেকে। বাকি ২০ শতাংশ চলে বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভর করে। গত কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠানটির বৈদেশিক সহায়তার ৬ ভাগ কমেছে। এ অবস্থায় নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের আয় দিয়ে সামাল দেওয়ার পাশাপাশি বিকল্প দেশ ও সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে।
এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির সহায়তা কমলে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি এনজিও কার্যক্রমের পরিধি কমিয়ে আনে। শ্রমিক নিয়ে কাজ করা রামপুরা ও মহাখালীর দুটি প্রতিষ্ঠান কর্মী কমিয়ে আনে।
ছিন্নমূল ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কর্মমুখী শিক্ষা দেওয়া একটি সংস্থায় গত কয়েক বছর ধরে বৈদেশিক সহযোগিতা বন্ধ। প্রতিষ্ঠানটি এখন পরিসর কমিয়ে চলছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিএসআর তহবিলের সহায়তায়।
বেসরকারি সংস্থার সংগঠক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে এনজিওগুলোর কার্যক্রম আশঙ্কাজনকভাবে কমবে। এর ফলে সুবিধাভোগী বিপুল জনগোষ্ঠী সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে।
তবে বাংলোদেশে যে সহায়তা দেওয়া হয় এবং যে কারণে দেওয়া হয়, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নীত হলেও সে কারণগুলো থেকে যাবে। যেমন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা থেকে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত অভিঘাতের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষতি মোকবিলার জন্য সহায়তা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নীত হলেও এ সমস্যাগুলো এখনো বিদ্যমান। এ জন্য বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হলেও এসব তহবিলের প্রয়োজনীয়তা থেকে যাবে। ফলে সহায়তা যাতে বন্ধ না হয়ে যায়, এজন্য নেগোশিয়েশন শুরু করার তাগিদ দিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, দাতারা বাংলাদেশে যেসব সহায়তা দেয়, এর কোনোটাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঠে যাবে না, উঠে যায় না। সহায়তা উঠিয়ে নেওয়ার আগে যে দেশ থেকে উঠিয়ে নেওয়া হবে, সেসব দেশের সঙ্গে আলোচনা করে তুলবে। ওই আলোচনা যখন শুরু হবে তখন আমরা যদি আমাদের প্রয়োজনীয়তা সক্ষমতার সঙ্গে তুলে ধরতে পারি তাহলে সহায়তা বন্ধ রোধ করা সম্ভব হবে।
উন্নয়ন সংস্থাগুলো বলছে, এক দশক ধরেই কমছে। এজন্য অনেক এনজিও কাজ গুটিয়ে নেওয়া শুরু করেছে। চলমান এনজিওগুলো বিকল্প তহবিল সংগ্রহের জন্যও মনোযোগ দিতে পারে।
দেশের বড় উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য কর্মকর্তা কাজী আবু মোহাম্মদ মোর্শেদ বলেন, এনজিও বলতে যারা বাংলাদেশের জন্য কাজ করি তাদের টাকা কমছে। কিন্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য যে টাকা এসেছে এবং এনজিওর সঙ্গে যোগ হওয়ার কারণে মনে হচ্ছে সহায়তা আগেরটাই আছে। নতুন প্রেক্ষাপটে ইউএসএআইডির অনুদান আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রোহিঙ্গাদের জন্য যে টাকাটা আসতো, সেটার বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এখন সর্বোপরি হঠাৎ করে কমেছে।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, সারা পৃথিবীতেই সহায়তা কমেছে। এই সহায়তা চলে যাচ্ছে ইউক্রেনে। তার আগে গেছে আফগানিস্তানে, তারও আগে গেছে তুরস্কের ভূমিকম্পে উদ্বাস্তুদের জন্য। নতুন নতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সহায়তার অর্থ ভাগ হচ্ছে।
বাংলাদেশে সহায়তা কমে যাওয়ার পেছনে আরও একটি বড় কারণ, বাংলাদেশ যেহেতু উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পথে এগুচ্ছে; সে জন্য বাংলাদেশে সহায়তা কিছুটা কমছে। আর একই সময়ে আরও অনুন্নত যেসব দেশ আছে, সেখানে এই টাকাটা চলে যাচ্ছে। এই দুইটার ইম্প্যাক্টের কারণে বাংলাদেশে বিদেশি সহায়তা কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের এনজিওগুলোর জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ, উল্লেখ করেন কাজী আবু মোহাম্মদ মোর্শেদ।
তিনি বলেন, যদি যুক্তরাজ্যের কথা ধরেন, সেখানে সারা বিশ্বের মধ্যে এনজিওর সংখ্যা বেশি। এসব এনজিও কিন্তু বাইরে থেকে কোনো সহায়তা পায় না, তারা চলে সরকারের টাকায়। বাংলাদেশেও এনজিওর অর্থের সহায়তা হতে হবে সরকার থেকে। এখন সরকারের অনেক প্রকল্প এনজিওর সঙ্গে কাজ করে। কিন্তু পদ্ধতিটা স্বচ্ছ না হওয়ার কারণে এখানে কারা সরকারের কাছ থেকে কত টাকা পায়, তার ইম্প্যাক্টটা বোঝা যায় না। এই টাকা কারা পায়, কীভাবে পায়, এর ইম্প্যাক্ট কী, তা সব সময় দেখা যায় না। কিন্তু সরকারের অর্থ সহায়তা বাড়তেই হবে।
ব্র্যাকের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, এনজিও এই যে গ্রামে ঘরে ঘরে গিয়ে কাজ করে দুনিয়ার কোথাও সরকার করে না। এগুলো এনজিওগুলোই করে। বাংলাদেশেও সেটা করতে হবে। এই টাকাটা সরকারের কাছ থেকেই আসতে হবে। এখন সময় এসেছে সরকারের অর্থ এনজিওর মাধ্যমে খরচের বিষয়টি আরও স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি পরিমাণটা বাড়ানো। এটা আস্তে আস্তে হবে বলে আমার ধারণা।
তিনি বলেন, এখন সব বিষয়ে সংস্কারের কথা হচ্ছে। এনজিওর বিষয়েও সংস্কার হওয়া উচিত, যাতে বৈদেশিক সহায়তার বিকল্প নিজস্ব দেশীয় হতে পারে।
বাংলাদেশে কি উন্নয়নশীল দেশের তকমার কারণে বৈদেশিক সহায়তা বন্ধ হবে, এ প্রশ্ন এখন সর্বত্র। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে রপ্তানি বাণিজ্য বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে। এ জন্য আরও কিছুটা সময় দরকার। ইতোমধ্যে সরকারের কাছে ব্যবসায়ীরা বিষয়টি স্পষ্ট করছেন। এ ক্ষেত্রে এনজিওর বিষয়টিও সামনে আনা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা এখনই শুরু করা দরকার। আলোচনায় গড়িমসি হলে বৈদেশিক সহায়তার হ্রাসের যে কথা বলা হচ্ছে, সেটা দ্রুত কমে যাবে। ভাটা পড়বে বৈদেশিক সহায়তায়।
জেডএ/এমজেএফ