বগুড়ায় বাদ্যযন্ত্র কেনা-বেচার বাজারে ধস নেমেছে। বড় কনসার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়া ও ছোট আকারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কমে যাওয়ায় বেচা-কেনা গত এক বছরে অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বিক্রির দোকান ঘুরে দেখা গেছে, গিটার, কি-বোর্ড, তবলা, হারমোনিয়াম বিক্রির জন্য সাজানো, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ক্রেতার সংখ্যা একেবারেই কম।
প্রতিবছর দুর্গাপূজার আগে ঢাক, ঢোল, শঙ্খ, ঘণ্টা, কোরতাল (কাঁসি) বিক্রির যে ভিড় থাকতো এবারও সেটাও কম। বগুড়ার বাদ্যযন্ত্রের একমাত্র মার্কেট শহরের চেলো পাড়া। এখানে ছোট-বড় ১২টি দোকান রয়েছে বাদ্যযন্ত্র কেনা-বেচার। এর মধ্যে কয়েকটি আছে শত বছরের পুরোনো। শহরের বাইরে শেরপুর, কাহালু, শিবগঞ্জ উপজেলায় আরও ৫/৬টি বাদ্যযন্ত্রের দোকান আছে।
দোকানিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত এক বছরে জেলার বাদ্যযন্ত্রের বাজারে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। আগে যারা নিয়মিত বাদ্যযন্ত্র কিনতেন তারা আর আসছেন না।
বাদ্যযন্ত্র ব্যবসায়ীদের মতে, বিক্রির বড় অংশ নির্ভর করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কনসার্ট ও স্টেজ শো আয়োজনের ওপর। কিন্তু গত এক বছরে এসব অনুষ্ঠান ব্যাপকভাবে কমে গেছে। বড় বড় কনসার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাউন্ড সিস্টেম, গিটার, ড্রাম সেট, কি-বোর্ডের মতো যন্ত্রের চাহিদা কমে গেছে। অন্যদিকে ছোট আকারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও কমে গেছে আগের তুলনায় অনেক। এই কারণে হারমোনিয়াম, তবলা, বাঁশি, একতারার মতো ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রের ক্রেতাও নেই বললেই চলে। গিটার, পিয়ানো, ইউকুলেল, হারমোনিয়াম, ড্রাম সেটসহ অন্তত ২০ ধরনের বাদ্যযন্ত্র বগুড়ার স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আমদানি করে থাকে। এ ছাড়াও ভারত থেকে তবলা ও ঢোলসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র আসে বগুড়ায়।

শহরের চেলো পাড়ায় বাদ্যযন্ত্র বিক্রির অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান এস আর দাস অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী দিলীপ কুমার দাস বলেন, ‘বাদ্যযন্ত্রের বাজার অনেক খারাপ। সাংস্কৃতিক অঙ্গন কার্যত স্থবির। বিক্রি ৫০ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে। আগে যেখানে মাসে ৪০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা বিক্রি হতো, এখন ১০ লাখ টাকার বাদ্যযন্ত্র বিক্রি করতেও কষ্ট হয়। ছোট-বড় সব ধরনের শো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। শুধু আমি নই, সবারই একই অবস্থা। ’
বাদ্যযন্ত্র বিক্রি আগের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে বলে দাবি করেছেন পাইকারী বাদ্যযন্ত্র বিক্রয়কারী আরেক প্রতিষ্ঠান সুরোশ্রীর স্বত্বাধিকারী সুজন কুমার দাশ। তিনি বলেন, ‘বিক্রি এখন নেই বললেই চলে, কোনো রকমে দিন পার করছি। করোনার সময় থেকেই ব্যবসা খারাপের দিকে যাচ্ছিল। এখন পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়ে উঠেছে। বিক্রি আগের তুলনায় কমে যাওয়ায় এবছর ‘বগুড়া মিউজিক’ নামে আমার এক দোকান বন্ধ করে দিয়েছি। আমার মতো আরও তিনটি দোকান বন্ধ হয়েছে। আগে যেখানে ক্রেতাদের ভিড় সামলাতে হতো, এখন দিনের পর দিন দোকান খোলা থাকলেও বিক্রি হয় না বললেই চলে। ’
শত বছর পুরোনো ‘সংগীত সুর বিতান’র স্বত্বাধিকারী নিখিল চন্দ্র বলেন, যেখানে প্রতিদিন কয়েকটি হারমোনিয়াম, তবলা, ডুগি, বাংলা ঢোল, ড্রাম সেট বিক্রি হতো, অনেক সময় বড় অর্ডারও আসত। এখন সে ক্রেতারা নেই বললেই চলে। যারা আগে বিপুল পরিমাণ বাদ্যযন্ত্র কিনতেন, তারা দোকানে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। কেবল হিন্দুদের পূজা-পার্বণের সঙ্গে সম্পর্কিত যন্ত্র কিছুটা বিক্রি হচ্ছে, তবে এর পরিমাণ খুবই সীমিত।
বগুড়ায় বাদ্যযন্ত্রের বাজারের আকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন পরিসংখ্যান না থাকলেও বিক্রেতাদের দাবি, স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানি মিলিয়ে এ বাজারের আকার বছরে প্রায় ৪০ কোটি টাকা।
বেশ কয়েকটি বাদ্যযন্ত্রের দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কনসার্ট, স্টেজ শো ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ বা কমে যাওয়াই বাজারের এ স্থবিরতার প্রধান কারণ। আগে এসব আয়োজন ছিল বাদ্যযন্ত্র বিক্রির মূল চালিকাশক্তি। এখন অনুষ্ঠান না থাকায় শুধু বিক্রি নয়, পুরো ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শহরের সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয় ঘুরে দেখা যায়, সেখানেও তেমন কার্যক্রম নেই। কয়েকজন সাংস্কৃতিককর্মী জানান, আগে প্রতিদিনই নানা ধরনের কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হতো। বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ও সাংস্কৃতিক মৌসুমে প্রচণ্ড চাপ সামলাতে হতো কর্মীদের। কর্মীরা শুধু পারফর্ম করতেন না বাদ্যযন্ত্র কেনাকাটাও করতেন। 
বগুড়া শহরের সব চেয়ে বড় মিলনায়তন শহীদ টিটু মিলনায়তন। এর সুপারভাইজার গোলাম আজম গোলাপ জানান, গত এক বছরে এই মিলনায়তনের ভেতরে বড় আকারে ২টি এবং এর বাইরে প্রাঙ্গণে ২০টি ছোট আকারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে, যা আগের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।
বগুড়া জেলা শিল্পকলা অ্যাকাডেমির কালচারাল অফিসার মাহমুদুল হাসান বলেন, সরকারিভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং প্রশিক্ষণ কমেনি। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বেসরকারি পর্যায়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনেক কমে গেছে। আর এ কারণেই হয়তোবা বাদ্যযন্ত্রের বাজার মন্দা যাচ্ছে।
এএটি


