শুক্রবারের সরেজমিন, বাংলানিউজের নিয়মিত উদ্যোগ। প্রতি শুক্রবার বাংলানিউজের একটি টিম চলে যাচ্ছে কোনো বিশেষ ঘটনাস্থল বা সাইটে।
নরসিংদী থেকে ফিরে: নরসিংদীর বারৈচা বাজারের ব্যস্ত ভোর। আলো ফুটতেই ভ্যানবোঝাই কাঁচা সবজি নিয়ে চাষীরা হাজির। স্থানীয় ভাষায় তারা হলেন ‘গেরস্থ’। বড় বড় ঝাঁকাভর্তি ফুলকপি, শিম, পেঁয়াজ কলি, আলু কিংবা বাঁধাকপি।
যত বেলা বাড়ে ততই সূর্যের মতো তেতে ওঠে ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক। বারৈচা এ অঞ্চলের অন্যতম বড় পাইকারী বাজার, তাই ঝাঁকা কম বেপারী বেশি। এতসব লাভ-লোকসানের ভিড়ে আলাদা করে নজর কাড়ে দু’টি হাত। ঝাঁকা থেকে ঝটপট সবজি তুলতে ব্যস্ত। প্রতি ঝাঁকা থেকে একমুঠো। বাঁধাকপি-ফুলকপিও সমানতালে উঠে আসছে হাতে। যে যার কাজ নিয়ে মগ্ন, এর মাঝেই ‘তোলা’ সবজিতে ভর্তি হচ্ছে অন্যজনের হাতে ধরা ঝুড়ি।
দূর থেকে হাতের মালিককে নারীই মনে হয়। কাছ যেতেই যেন ভোজবাজিতে কণ্ঠস্বর বদলে হয়ে গেলেন পুরুষ! মানে কাপড়ে-চোপড়ে নারী, কিন্তু অঙ্গভঙ্গি বা মুখাবয়ব পুরুষালি। সমাজে তারা পরিচিত ‘হিজড়া’ নামে। আর প্রাণিবিদ্যায় ট্রান্সজেন্ডার বা উভলিঙ্গ। সহজে বললে, প্রাকৃতিকভাবে যারা নারী-পুরুষ উভয়ের বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেন।
যাই হোক, হাতের মালিকের নাম কল্পনা সরকার। আজ থেকে ২০ বছর আগে বছর বত্রিশের এ মানবসন্তানকে ‘হিজড়া’ হওয়ার দায়ে ঘর ছাড়তে হয়। তারপর থেকেই শুরু। প্রায় দুই দশক এই ‘তোলা’ সবজিতেই মিলছে তার অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান। বলা ভালো, তাদের। কারণ দীর্ঘ এ পথচলায় কল্পনা এখন আর এক নন, আকাশি-কোয়েলিরাও এখন তার সুখ-দুখের ভাগীদার।
শোনা যাক তার মুখেই, বারৈচা বাজারের কাছেই আমরা ১০জন ঘর তুলে থাকি। এদের আমিই খুঁজে খুঁজে এনেছি। দু-একজন অবশ্য খোঁজ-খবর করে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এভাবেই গেরস্থদের ঝাঁকা থেকে সবজি তুলে আমাদের চলে।
এতজনের ভরণ-পোষণ সামান্য সবজি তুলে! কি হয় এতে! ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে আসে।
হয়ত বুঝতে পেরেই বলতে শুরু করেন কল্পনা, এভাবে এক-দুইমুঠো করে আমরা দিনে তিন থেকে চারমণ সবজি তুলে ফেলি। পরে স্থানীয় বাজারে এগুলো বিক্রি করলে তিন-চার হাজার টাকা পাওয়া যায়। এতেই চালাতে হয়, কী আর করা!
তাই বলে রোজ রোজ এভাবে পরের ঝাঁকা থেকে সবজি তোলা, আপনাদের তো মার লাগানোর কথা!
আমাদের কেউ কিছু বলে না। আর রোজ রোজ নয়, হাট বসে সপ্তাহে তিনদিন। ওই তিনদিনই পালাক্রমে দু’জন করে সবজি তুলতে যাই, কল্পনার ঝটপট জবাব।
এদিন কল্পনার সঙ্গে দু’জনের একজন ছিলেন পায়েল (২১)। তারও এভাবে কেটে গেল চার-পাঁচবছর। সারাজীবন এভাবেই চলবে?
হাতে সবজিভর্তি ঝুড়ি নিয়েই বললেন, আর তো কোনো কাজ পাই না! প্রায়ই শুনি, সরকার আমাদের কাজ দেবে, কই দেয় তো না। কেউ কাজ না দিলে আমাদের কি দোষ! অন্য কোনো উপায় নেই বলেই তো সবজি তুলে বেঁচে থাকতে হয়।
কথা হয় স্থানীয় গেরস্থ সাইদুল মিয়ার (৪৪) সঙ্গে। কল্পনাদের সবজি তোলা নিয়ে তার ভাষ্য, এখানে প্রায় সবারই নিজের ক্ষেতের ফসল। সেখান থেকে ওরা একটু তুলে তুলে নেয়। এজন্য কেউ তেমন কিছু বলেন না। কেউ কেউ হয়ত মানা করেন।
যে বাজারের সবজি তুলে এতগুলো মানুষের জীবন চলে, তা নিয়ে কোনো কথা হবে না তা কী হয়! ভৌগলিক অবস্থানে, নরসিংদীর শিবপুর উপজেলায় পড়ছে বারৈচা বাজার। ভৈরব যেতে প্রায় এক কিমি. আগে।
রাজধানীসহ সিলেট-চট্টগ্রামের সবজি যোগানের বড় একটি অংশ যায় নরসিংদীর মাঠ থেকে। রোজ টনকে টন কাঁচা সবজি স্থানীয় বারৈচা, বালাবো, চৈতন্যর মতো বড় বাজার থেকেই রপ্তানি হয়ে থাকে।
আর বারৈচার এ সবজি প্রান্তরে যে জীবন কল্পনার, পায়েলের; তার সঙ্গে বাংলানিউজের হয় দেখা। শুক্রবার (০৯ জানুয়ারি) দেশের এ প্রথমসারির সংবাদমাধ্যমটির সরেজমিন প্রতিবেদনে উঠে আসে জীবনের মধ্যে অন্য এ জীবন।
সে জীবন ঘরছাড়া আর পরিবার-পরিজনহীন। কেউ বাবা-মার মুখটা ভুলতে বসেছেন, কারো বুকে ‘হিজড়া’ হওয়ার দুঃখ। না পরিবারে ঠাঁই হয়েছে, না সমাজে। তাদের এ অবস্থার জন্য কেবল এই একটি বিষয়ই দায়ী বলে মনে করেন তারা।
যেতে যেতে সবজির কাঁচা গন্ধের ভেতর কেবল পায়েলের কথাটাই যেন বিঁধে থাকে, আমাদের জীবন-মরণ, সবকিছু এখন ‘সবজি’!
বাংলাদেশ সময়: ০৮২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৪
অর্থনীতি-ব্যবসা
শুক্রবারের সরেজমিন
‘তোলা’ সবজিতেই কল্পনাদের জীবন
শুভ্রনীল সাগর, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।