ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

ট্যানারি মালিকদের কৌশলেই চামড়ার বাজারে ধস  

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৮
ট্যানারি মালিকদের কৌশলেই চামড়ার বাজারে ধস   চামড়ার বাজারে ধস  

যশোর: চামড়া ব্যবসার সবচেয়ে বড় মৌসুম কোরবানির ঈদ। ফলে দেশের বৃহত্তর চামড়ার মোকাম যশোরের রাজারহাট, নাটোর, ঢাকার পোস্তার পাইকারি ব্যবসায়ী এবং সারাদেশের মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মধ্যে তৎপরতা বেড়ে যায়। এতে করে ক্রেতা বেশি হওয়ায় বাজারে চামড়ার চাহিদা যেমন বাড়ে, তেমনি দামও ভালো থাকে। 

তবে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, গত দুই বছর ট্যানারি মালিকরা ঈদের আগে বিভিন্ন অজুহাত তুলে বকেয়া টাকা পরিশোধ করেনি। এমনকি, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা নেই জানিয়ে বড় বড় মোকামের ব্যবসায়ীদের চামড়া কিনতে নিরুৎসাহিত করছে।

যার ফলে এবছরও গ্রাম পর্যায়ে অনেকটা পানির দামেই চামড়া বিক্রি হয়েছে।  

যশোর এবং ঢাকার পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের আগে ট্যানারি মালিকরা তাদের বকেয়া শত কোটি টাকা পরিশোধ না করায় ব্যবসায়ীরা পুঁজি সংকটে পড়ে, যার কারণে গ্রাম পর্যায়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অগ্রিম চামড়ার টাকা দিতে পারিনি, বরং চামড়ার প্রতি অনিহা দেখায়। এ কারণেই মৌসুমি ব্যবসায়ীরা নিজেদের টাকা দিয়ে ইচ্ছামাফিক পানির দামেই চামড়া কিনেছেন। যেহেতু, গ্রাম কিংবা শহরে কোরবানির পরে যেসব এতিমখানা কিংবা মাদ্রাসা, লিল্লাহ বোডিং চামড়া সংগ্রহ করেছে, তাদের অনেকেরই কাঁচা চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণের পদ্ধতি জানেন না, অনেকে জানলেও বাজারে চাহিদা না থাকায় নিরুৎসাহিত হয়ে পানির দামে বিক্রি করেছেন।  

এদিকে, ঈদ পরবর্তী সময়ে ট্যানারি মালিকরা বিভিন্ন চামড়ার মোকামে নিজেরা গিয়ে ও প্রতিনিধি পাঠিয়ে বিভিন্ন বাজার থেকে চামড়া কিনছেন। এতে করে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় তুলনামূলক কম দামেই চামড়া কিনতে পারছেন তারা। অথচ, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের এতিম-মাদ্রাসা ছাত্ররা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হলো এবং ট্যানারি মালিকদের কাছে কোটি কোটি টাকা অনাদায়ী ব্যবসায়ীরাও লাভের মুখ দেখতে পারলো না।  

চামড়া ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ট্যানারি মালিকরা সরকারের কাছ চামড়া কিনতে ব্যাংক ঋণসহ সব সুবিধা নিলেও প্রকৃত চামড়া ব্যবসায়ীদের অগ্রিম টাকা দেওয়া দূরে থাক, বকেয়াও পরিশোধ করছে না। এতে শুধুমাত্র রাজারহাট মোকামের ক্ষুদ্রব্যবসায়ীরা প্রায় ২০ কোটি টাকা পাবে ট্যানারি মালিকদের কাছে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ঢাকার ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনতে ব্যাংক লোন নিয়ে গাড়ি-বাড়ি ও অন্যান্য ব্যবসায় লগ্নি করে আর চামড়া ব্যবসায় লোকসান দেখিয়ে ঋণখেলাপি সাজে। প্রতিবছর কোরবানি ঈদের আগে ব্যাংক লোন দিলেও মূলত তারা পুরোনো টাকার সমন্বয় করে। এতে করে পুঁজি হারাতে বসেছে তৃণমূলের চামড়া ব্যবসায়ীরা। যার বিরুপ প্রভাব পড়েছে চামড়ার বাজারে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ট্যানারি মালিকদের অনেকেই সরাসরি হাটে-মোকামে গিয়ে চামড়া কিনছেন, এতে ব্যবসায়ী ও চামড়া বিক্রেতারা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।  

রাজারহাটের চামড়া ব্যবসায়ী খায়রুল বাশার বাংলানিউজকে বলেন, ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে কখনোই অগ্রিম টাকা পায়না, এবারও পায়নি। বরং অধিকাংশ ব্যবসায়ী তাদের পাওনা টাকার ২০ শতাংশ অথ্যাত ১ লাখে ২০ হাজার করে বকেয়া টাকা পেয়েছে। এই সামান্য টাকা দিয়ে কিভাবে তারা চামড়া কিনবেন বলেও প্রশ্ন তোলেন তিনি!

রাজারহাট চামড়া মোকামের ইজারাদার শেখ হাসানুজ্জামান হাসু বাংলানিউজকে বলেন, সরকার নজর না দিলে চামড়া ব্যবসায়ীরা পথে বসবে, তিনি আরও জানান ঢাকার ট্যানারি মালিকরা যতো অজুহাত সব দেখায় গরিব ব্যবসায়ীদের। আর সেই প্রভাব ফেলে একদম তৃণমূলে।  

রাজারহাট চামড়া ব্যবসায়ী কল্যান সমিতির সভাপতি আব্দুল মালেক বাংলানিউজকে বলেন, কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে সরকার ট্যানারি মালিকদের কোটি প্রায় হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। আমরা তো সরকারি ঋণ পাই না, ট্যানারিতে অগ্রিম টাকাও চাচ্ছি না। আমাদের পাওনা বকেয়া টাকা না দিলে আমরা কিভাবে চামড়া কিনব বলে প্রশ্ন করেন তিনি। তিনি বলেন, চামড়া কিনে পরিষ্কারের জন্য ৮ জন শ্রমিক নিয়েছি। আগেভাগেই কয়েক মণ লবণ কিনে রেখেছি। অথচ, বয়েকা টাকা না পেয়ে খুবই হতাশায় রয়েছি। একইসঙ্গে তিনি বলেন, গত চারবছর আগের তুলনায় এবার কোরবানি পশুর চামড়া চারভাগের একভাগে নেমে এসেছে।  

বৃহত্তর যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন মুকুল বাংলানিউজকে বলেন, ঈদের আগে কয়েকদিন ধরে টাকার জন্য ঢাকায় ট্যানারিতে পড়ে থেকেও, বকেয়া টাকার ২০ শতাংশ হাতে পেয়েছি। এ অল্প টাকায় কিভাবে আমরা চামড়া কিনব?

চামড়ার দাম কমানো প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে আলাউদ্দিন মুকুল বলেন, চামড়ার দাম কমলে ট্যানারি-বড় পাইকার কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না। এতে একমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এতিম ও গরিব-অসহায় লোকজন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কোরবানির পশুর চামড়ার ৯৫ ভাগই বিভিন্ন মাদ্রাসার এতিম শিশু ও গরীব মানুষের মধ্যে দান করা হয়। ফলে বাজারে চামড়ার দাম কমে গেলে তারা তাদের ন্যায্য হক থেকে বঞ্চিত হয়।

ঢাকার পোস্তার পাইকারি আড়ৎ মালিক হাজী আব্দুল হালিম বাংলানিউজকে বলেন, ঈদ পরবর্তী দিনগুলোতে ঢাকায় চামড়ার দাম কম হওয়ায় বাইরের মোকামে যাচ্ছি না, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। এখন ঢাকায় চামড়া বেচাকেনা শেষ, আর সাত দিন পরে আবার বেচাকেনা হবে। চামড়ার দাম প্রসঙ্গে বিশিষ্ট এই ব্যবসায়ী বলেন, ট্যানারি মালিকরা আমাদের শত’ কোটি টাকা বকেয়ার ২০-২৫ শতাংশ পরিশোধ করেছে। এত পুঁজি সংকটে কম দামে চামড়া কিনতে হচ্ছে, এরই মধ্যে মধ্যবিত্তদের টাকা শেষ। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ট্যানারি মালিকরা নিজেরাই চামড়া কিনছে। সম্প্রতি আল-মদিনা ট্যানারির মালিক ব্যবসায়ীদের টাকা না দিয়ে নগদ টাকায় পোস্তা থেকে চামড়া কিনে ফেরার পথে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, এ ঘটনাকে আল্লাহ বিচার করেছেন বলে আমরা মনে করি। শুধুমাত্র আল-মদিনা নই, সব ট্যানারি মালিকরা নিজেরা পরিকল্পিতভাবে আমাদের টাকা দেয়না, আর নিজেরা নগদে চামড়া কেনে। আমরা যেন ট্যানারি মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে গেছি, কিছু বলতে গেলে তারা বলে পারলে আদায় করো, বেচাকেনা নেই টাকা দিতে পারব না।  

এদিকে, শনিবার ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, চামড়া শিল্পে ক্রান্তিকাল চলছে। বেশিরভাগ ট্যানারি উৎপাদনে নেই। গত বছরের ৪০-৪৫ শতাংশ চামড়া এখনও অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে। চামড়া শিল্পের এমন দশার নেপথ্যে রয়েছে সরকারি সহায়তা না থাকা আর পুঁজি সংকট।  

বিটিএ সভাপতি আরও বলেন, সাভারে পরিকল্পিত ট্যানারি শিল্প গড়ে না ওঠার দায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক)। ভুল তথ্য দিয়ে ট্যানারি মালিকদের সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছিলো। এখানে যে বিনিয়োগ করেছিলো ট্যানারি মালিকরা তা মাঠে মারা গেছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৫১০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৮
ইউজি/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।