ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

লোকসানের বোঝা শ্রমিকের ঘাড়ে, আখ মাড়াই উদ্বোধন শুক্রবার

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৮
লোকসানের বোঝা শ্রমিকের ঘাড়ে, আখ মাড়াই উদ্বোধন শুক্রবার রাজশাহী সুগার মিল। ফাইল ফটো

রাজশাহী: ছয় হাজার মেট্রিক টন অবিক্রিত চিনি পড়ে আছে রাজশাহী চিনিকলের গুদামে। অব্যাহত লোকসানে শতকোটি টাকার দেনায় ডুবেছে মিলটি। মিলে উৎপাদিত চিনির নির্ধারিত মূল্যের তুলনায় বাজারমূল্য কম হওয়ায় চিনি বিক্রি হচ্ছে না। ফলে মিলের প্রায় ১ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী বেতন পাননি ছয়মাস ধরে। 

লোকসানের বোঝা শ্রমিকদের ঘাড়ে তুলে দিয়ে আখ মাড়াই মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে শুক্রবার (২৩ নভেম্বর)। শ্রমিকদের অব্যাহত দাবির মুখে বকেয়া বেতনের আংশিক পরিশোধের প্রক্রিয় শুরু হয়েছে সদ্য।

তবে সেখানেও রয়েছে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’।  

মিলের শ্রমিক-কর্মচারীরা জানান, বকেয়া বেতন-ভাতার ১৬ শতাংশ কেটে বেতন পরিশোধ করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, বাংলদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের লোকসান পূরণে বেতনের নির্দিষ্ট অংশ রেখে দেওয়া হচ্ছে। ফলে আর্থিক কষ্টে থাকা শ্রমিক-কর্মচারীরা নিরুপায় হয়ে ১৬ শতাংশ কমে বেতন নিচ্ছেন।

বর্তমানে রাজশাহী চিনিকলের গুদামে দুই মৌসুম মিলে প্রায় ৫০ কোটি টাকার চিনি অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ফলে চলতি বছরের জুন-নভেম্বর পর্যন্ত ছয় মাস চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন বকেয়া পড়ে যায়। বেতনের দাবিতে তাদের অব্যাহত দাবির মুখে জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের বেতন ১৬ শতাংশ কেটে রেখে পরিশোধ করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে অর্ধেক শ্রমিক-কর্মচারীদের কোনো অংশ না কেটে জুন মাসের পুরো বেতন পরিশোধ করা হয়। পরে ওই মাসে বেতনের ১৬ শতাংশ রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর বাকি শ্রমিক-কর্মচারীরা জুন মাসের বেতন পাননি।

রাজশাহী চিনিকলের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, চলতি বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন ১ লাখ মেট্রিক টন চিনি বিদেশ থেকে আমদানি করে। আমদানির পরপরই চিনির বাজারদর কমে যায়। করপোরেশন প্রতিকেজি চিনির মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজার মূল্য ৪০-৪২ টাকা। তাই করপোরেশন বাজার মূল্যে আমদানি করা চিনি বিক্রি করে তার লোকসান মিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনের নির্দিষ্ট অংশ কেটে পূরণ করা হচ্ছে।

বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য না থাকায় করপোরেশনের নিবন্ধিত ডিলাররা মিলের চিনি কিনছেন না। এজন্য চিনি কলের গুদামে কোটি কোটি টাকার চিনি অলস পড়ে আছে। ফলে মিল কর্তৃপক্ষ পড়েছে আর্থিক সংকটে। একদিকে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন বকেয়া, অন্যদিকে ঋণের বোঝা। দিনে দিনে দুটোই আরও ভারী হয়ে উঠছে।

সরেজমিনে রাজশাহী চিনিকলে গিয়ে জানা যায়, শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করে ভিন্ন দু’টি খাতায় লিখে তাদের স্বাক্ষর নেওয়া হচ্ছে। একটি খাতায় তাদের আসল বেতন-ভাতা ও অন্য খাতায় ১৬ শতাংশ বাদে পরিশোধিত বেতন লেখা হচ্ছে।

বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য না থাকায় করপোরেশনের নিবন্ধিত ডিলাররা মিলের চিনি কিনছেন না। কোটি কোটি টাকার চিনি অলস পড়ে আছে। ফলে চিনিকল মিল কর্তৃপক্ষ আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছে। একদিকে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন বকেয়া, অন্যদিকে ঋণের বোঝা নিয়ে এক সময়ের লাভজনক শিল্পটি রুগ্ন হয়ে পড়েছে।  

মিলের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বেতন বন্ধ থাকায় শ্রমিক-কর্মচারীদের শোচনীয় অবস্থার মধ্যে আছেন। কারো পরিবারে খাদ্য, ওষুধ কেনার টাকা নেয়। কয়েকজন কর্মচারী গুরুতর অসুস্থ হয়ে টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। তাই বাধ্য হয়ে ১৬ শতাংশ ছাড় দিয়ে তারা বেতন নিচ্ছেন।

করপোরেশনের লাভ হলে শ্রমিকরা তার কোনো অংশ পাননা। অথচ লোকসান হলে তার বোঝা শ্রমিক-কর্মচারীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া খুবই অমানবিক। কর্তৃপক্ষের ‘সিদ্ধান্তহীনতা’ ও ‘স্বেচ্ছাচারিতার’ কারণে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।  

রাজশাহী চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবু বক্কর সিদ্দীক বলেন, বেতনের দাবিতে আমরা প্রধানমন্ত্রীর দফতরসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তিন মাস আগে লিখিতভাবে জানিয়েছি। কিন্তু এখনও আমরা কোনো প্রতিকার পাইনি। আমাদানি করা চিনি কম দামে বিক্রি করে আমদের কাছ থেকে কেন লোকসান উশুল করা হবে? রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি শ্রমিকদের বেতন থেকে কেটে নেওয়া অযৌক্তিক। সরকার চাইলে চিনির দাম কমাতে পারে। কিন্তু উল্টো আমাদের বেতন কাটা হচ্ছে। তাহলে সাধারণ শ্রমিকরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

সার্বিক বিষয়টি জানতে রাজশাহী চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশফাকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি।

তবে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান একেএম দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমদানি করা চিনির লোকসান পূরণে শ্রমিক-কর্মাচারীদের বেতন কাটা হচ্ছে না। বরং সংশ্লিষ্ট চিনিকল তাদের চিনি বিক্রির লোকসান পূরণে বেতনের নির্দিষ্ট অংশ রেখে দিচ্ছে। মিলগুলোকে উৎপাদিত চিনি বিক্রি করেই শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতস-ভাতা দিতে হবে।  

মিলগুলো চিনি বিক্রি করতে পারছে না, আবার মিলের চিনির দাম কমালে প্রায় ৫শ কোটি টাকার লোকসানে পড়তে হবে বলেও মন্তব্য করেন চিনি শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান।

বাংলাদেশ সময়: ০২১৫ ঘণ্টা, নভেস্বর ২৩, ২০১৮
এসএস/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।