আধুনিক জ্ঞান ও শিল্পঋণের অভাব, বাজারজাতকরণে সহায়তা না পাওয়া, ই-মার্কেটিং, ই-বিজনেস সম্পর্কে ধারণা না থাকা, উচ্চ আমদানি শুল্ক আরোপ, আমলাতান্ত্রিক নানা জটিলতার কারণে এ শিল্পটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রশাসনের নানা রকম হয়রানি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এ শিল্পের বিকাশে।
এজন্য মান নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনসহ এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারে প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা।
সুজানগরের কয়েকটি কারখানা ঘুরে দেখা যায়, বিশ্ববাজারে আগর-আতরের ব্যাপক চাহিদা থাকায় মৌলভীবাজারের প্রায় সবক’টি উপজেলায় ছোটবড় বাগানের পাশাপাশি বসতবাড়ির আঙিনায় আগর চাষ করা হচ্ছে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ৫০ থেকে ৬০ হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিক।
এক সময় আগর গাছে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ক্ষতের রেজিনযুক্ত কাঠ থেকে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে আগর তেল বা সুগন্ধি তৈরি করা হতো। বর্তমানে কৃত্রিমভাবে সংক্রমণ ঘটিয়ে ১২-১৫ বছর বয়সের আগর গাছ থেকে মূল্যবান আগর সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে। সুজানগর ইউনিয়নের বাড়িতে বাড়িতে প্রায় সাড়ে তিন শতাধিক আগর কারখানা রয়েছে। তবে অধিকাংশই ছোট ও মাঝারি আকারের। শুধু বড়লেখায় বছরে আগরের নির্যাস (তেল) উৎপাদিত হয় প্রায় দুই হাজার লিটার। এক লিটার কাঁচা আতরের স্থানীয় বাজার মূল্য ৬ লাখ টাকার বেশি। এই ২ হাজার লিটার নির্যাস বিদেশে বিক্রি করে প্রায় ১২০ কোটি টাকা আয় হচ্ছে। এছাড়া রপ্তানি হচ্ছে প্রচুর সংখ্যক আগর কাঠ। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আগর কাঠ ধূপের মতো জ্বালিয়ে সুগন্ধি তৈরি করে।
আগর রপ্তানিকারকরা জানান, উৎপাদন পদ্ধতির আধুনিক কৌশল সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবসহ বাজারজাতকরণে সরকারের সহযোগিতা না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য নিয়ে দর-কষাকষি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দেশের রপ্তানি খাতে অবদান রাখার সুযোগ থাকলেও পারছে না আগর-আতর শিল্প। এজন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দেওয়া হলে ব্যক্তি উদ্যোগে আগর চাষ বাড়বে।
শুধু তাই নয়, এ শিল্পে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এছাড়া রপ্তানির ক্ষেত্রে আইনি বিভিন্ন জটিলতার কারণে আগর-আতর উৎপাদনকারীরা ফ্রান্স, ভারত, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে অবৈধপথে বছরের পর বছর ধরে আগর-আতর রপ্তানি করছেন। এতে সরকারও প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।
বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট আনসারুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ২০১৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বড়লেখা ডিগ্রি কলেজ মাঠের জনসভায় আগর-আতরকে ক্ষুদ্রশিল্প হিসেবে ঘোষণা করেন। আগর শিল্পের স্বার্থে গ্যাস সংযোগ দিতে হবে। প্রায় তিন শতাধিক কারখানার মধ্যে অর্ধেকের বেশি কারখানায় গ্যাস সংযোগ নেই। আর যেসব কারখানায় গ্যাস সংযোগ রয়েছে, সেগুলোতে গ্যাসের চাপ কম থাকায় আগুনের তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় ঠিকমতো আতর উঠছে না। এ শিল্পের অগ্রগতির জন্য পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি গ্যাস বিলিংয়ের ক্ষেত্রে শিল্প হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে বিলিং করতে হবে।
অ্যাসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মজিবুল ইসলাম তারেক বাংলানিউজকে বলেন, আগর বের করার পর কাঠের ডাস্টগুলো ফেলে দেওয়া হয়। সেটা আমাদের দেশে কোনো কাজে লাগে না। বর্তমানে এ ডাস্টগুলো প্রক্রিয়া করে প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১৪০ টাকা দরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।
তবে গাছ কাটা থেকে শুরু করে গ্যাস সংযোগ ও রপ্তানির জন্য মান নির্ণয়ে দেশে কোনো ব্যবস্থা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টির পাশাপশি সঠিক দাম পান না ব্যবসায়ীরা। গ্যাস সংযোগ থাকলে আতর তৈরি কারখানা সাড়ে তিনশ থেকে এক হাজারে পরিণত হবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়বে অরো ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষের।
এ প্রসঙ্গে এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, শতভাগ স্থানীয় কাঁচামালে তৈরি আগর-আতর বাংলাদেশের একটি প্রিমিয়াম পণ্য হতে পারে। তাই সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা পেলে আগর-আতর হতে পারে তৈরি পোশাকশিল্পের মতো আরেকটি নির্ভরযোগ্য রপ্তানিমুখী শিল্প। যার মাধ্যমে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
তিনি জানান, এসএমই ফাউন্ডেশন এ শিল্পের অধীনে তিন কোটি টাকার সহজ শর্তেও ঋণ অনুমোদন করেছে। যা ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু নানা সমস্যায় এ শিল্পটির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৮
জিসিজি/এমআইএইচ/এএ