শিল্পাঞ্চল সাভার ও আশুলিয়ায় নামী-বেনামী এমন নেতা ও শ্রমিক সংগঠনের অভাব নেই। বেশির ভাগ শ্রমিক সংগঠন শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করার বিপরীতে উল্টো তাদের বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, নিরীহ শ্রমিকদের নাম ট্রেড ইউনিয়নের নামে বিক্রি করে কারখানা মালিকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা, হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে পোশাক খাতকে।
কয়েকদিনের অনুসন্ধানে সাভারের আশুলিয়ায় এধরনের বেশ কিছু সংগঠন ও নেতার খোঁজ মিলেছে। যার মধ্যে বাংলাদেশ তৃণমূল গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শামীম খাঁন অন্যতম। তার বিরুদ্ধে কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার নামে শ্রমিকসহ কারখানা মালিকদের জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, শামীম খাঁন প্রথমে একটি পোশাক কারখানা নির্বাচন করেন। পরে, ওই কারখানার কিছু শ্রমিকের পরিচয়পত্রের ফটোকপি কৌশলে সংগ্রহ করেন ও কাগজপত্র প্রস্তুত করে কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের অনুমতির জন্য শ্রম অধিদপ্তরে জমা দেন। এরপর, কারখানা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে ট্রেড ইউনিয়ন না করার শর্তে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করেন তিনি। কোন কোন শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন করতে চায়, সে তথ্য দেওয়ার শর্তে কারখানা মালিক চাঁদার টাকা পরিশোধ করেন। এভাবেই প্রায় অর্ধশতাধিক কারখানা মালিকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকা। শুধু শামীম খাঁন নন, আরও কয়েকজন শ্রমিক নেতা আছেন, যারা এই টাকায় বাড়ি-গাড়ি কিনে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন।
কোনো এক অজানা কারণে কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকেরা। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই সিন্ডিকেট গড়ে দিনের পর দিন অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে কিছু অসাধু লোকজন।
কারখানা মালিকেরা ট্রেড ইউনিয়নের কাগজপত্রে যে শ্রমিকদের নাম পাচ্ছেন, তাদের ছাটাই করে দিচ্ছেন। আর এ ছাটাইকে কেন্দ্র করে শুরু হচ্ছে অসন্তোষ-আন্দোলন। কোনো কোনো সময় আন্দোলনের মুখে কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা। অথচ শ্রমিকেরা জানতেও পারছেন না, তাদের কেন ছাটাই করা হয়েছে। কারণ, তাদের পরিচয়পত্র কৌশলে সংগ্রহ করা হয়। এভাবে, একদিকে যেমন অসাধু চক্র ও শ্রমিক নেতা হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। অন্যদিকে, চাকরি হারাচ্ছেন কিছু নিরীহ শ্রমিক। সেই সঙ্গে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে পোশাক কারখানাগুলো।
গত ৮ সেপ্টেম্বরে আশুলিয়ার ইএসকেই কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের কারণে চাকরি হারান পোশাক শ্রমিক সেলিনা। এরপর আর কোথাও চাকরি পাননি তিনি। অভাবের সংসারে ওই চাকরিটাই ছিল সেলিনার পরিবারের মূল চালিকাশক্তি।
সেলিনা বাংলানিউজকে জানান, তারা ৩০ জন শ্রমিক মিলে একটি ফেডারেশনের মাধ্যমে ট্রেড ইউনিয়নের কমিটি জমা দেন। এর কয়েকদিন পরেই সেই ৩০ জনকে বিনা নোটিশে ছাটাই করা হয়।
তিনি বলেন, কারখানা থেকে ছাটাই করে দেওয়ার পর সেসময় আমরা শ্রমিকদের কাজে ফেরানোর জন্য আন্দোলন করেছিলাম। তখন সেই ফেডারেশনের কেউ আমাদের সহযোগিতা করেনি। পরে, জানতে পারলাম, কারখানা মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সমঝোতার মাধ্যমে কয়েক লাখ টাকা নিয়েছেন শ্রমিক নেতারা। সেই সঙ্গে সেই ট্রেড ইউনিয়নের তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, তাদের ছাটাই করা হয়েছে।
অসাধু শ্রমিক নেতাদের দৌরাত্ম প্রসঙ্গে ডেবনিয়র কারখানার মালিক আইয়ুব খান বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের নামে অনেক শ্রমিক নেতাই টাকা খেয়েছেন। শামীম খাঁনও ট্রেড ইউনিয়ন জমা দিয়েছিলেন। কোনো কারণে তার ট্রেড ইউনিয়নটি বাতিল হয়ে গেছে। বর্তমানে আমাদের কারখানা সুন্দরভাবে পরিচালিত হচ্ছে। আজকাল আবার কিছু অসাধু শ্রমিক নেতা আমাদের কর্মকর্তার কাছ থেকে ট্রেড ইউনিয়নের নামে টাকা নেওয়ার পায়তারা করছে। তাদের ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে কারখানায় স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। হয়তো অনেক কারখানার মালিকেরা ট্রেড ইউনিয়ন চান না। কিন্তু, ট্রেড ইউনিয়ন করলে কারখানা শ্রমিকেরাসহ সবাই সুন্দরভাবে কাজ করতে পারে।
এ বিষয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের সদস্য সচিব বদরুদ্দোজা নিজাম বাংলানিউজকে বলেন, এই সিন্ডিকেটে আছে কিছু ভুয়া শ্রমিক নেতা, রেজিস্টার্ড ট্রেড ইউনিয়ন ও বিজিএমইএ’র লেবার সেলের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। তারা ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করেন। এরপর, নির্ধারিত অধিদপ্তর থেকে কারখানা মালিকদের একটি চিঠি পাঠানো হয়। পরে শ্রমিক নেতা, মালিক পক্ষ ও রেজিস্টার্ড ট্রেড ইউনিয়নের কর্মকর্তারা ওই কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন না করার শর্তে সমঝোতায় আসেন। মালিকেরাও চান না যে, তাদের কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন হোক। এরপর, কিছু নিরীহ শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়।
তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু, কোনো কাজ হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব শ্রমিক নেতা শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেন না। তারা শুধু সিন্ডিকেট তৈরি করে টাকা উপার্জন করেন। এই শ্রমিক নেতারাই গার্মেন্টস শিল্পকে নাজুক অবস্থায় নিয়ে গেছেন। এই প্রক্রিয়ায় টাকা উপার্জনের জন্য অসাধু শ্রমিক নেতারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন।
তবে, যার নাম বারবার আসছে, সেই শামীম খান তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের তো বেতন নেই। আমরা চলবো কীভাবে? শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করবো কীভাবে?
অভিযোগ প্রসঙ্গে শামীম খান বলেন, কারখানার মালিক, শ্রমিক সংগঠনের নেতাসহ সবাই আমার উপর ঈর্ষান্বিত হয়েই এই অভিযোগগুলো করছেন।
এ ব্যাপারে শিল্প পুলিশ-১’র পুলিশ সুপার (এসপি) সানা শামীনুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা যদি সত্যি ঘটে, সেটি দুঃখজনক। বিষয়টি তদন্ত করে প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৯
একে