ব্রিটিশকালে উত্তরাঞ্চলের তথা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাণিজ্য পরিচালিত হতো কুড়িগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চিলমারী নৌ-বন্দরটিকে ঘিরেই। তৎকালীন জমিদার ও মহাজনরা চিলমারী বন্দর থেকেই পণ্য আনা-নেওয়াসহ ব্যবসা পরিচালনা করার পাশাপাশি এই অঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠাতো।
এভাবেই নিজের চোখে দেখা সেই ঐতিহাসিক স্মৃতি রোমন্থন করে চিলমারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক দেলওয়ার হোসেন (৯৫) ঐতিহাসিক নৌ-বন্দরের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, সেই সময় বিশাল দরিয়ার মতো ছিলো ব্রহ্মপুত্র নদ, ছিলো অথৈ পানি। চিলমারী বন্দরে বড় বড় জাহাজ ও জমিদারদের পাল তোলা বিশাল আকৃতির নৌকা ভিড়তো। হাজারো মানুষের আনাগোনায় বিশাল কর্মযজ্ঞ চলতো সারা বছরজুড়েই। তিনি আরও বলেন, নৌ-বন্দরকে ঘিরেই কর্মসংস্থান মিলতো হাজার হাজার খেটে-খাওয়া মানুষের। এই বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে হাজার হাজার মণ পাট, ধান, চাল প্রভৃতি পণ্য নিয়ে বড় বড় জাহাজ চলাচল করতো। বন্দরটিকে ঘিরে চিলমারীতে গড়ে উঠেছিলো পাট, সরিষা, ধান, গম, বাদাম, তিসি ও ভুট্টার গুদামঘর। দেশের নামিদামি পাট কোম্পানিগুলো চিলমারীতে এসে অফিস খুলে পাট কিনতেন। এছাড়া বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে বিভিন্ন ধরনের মালামাল কেনার জন্য দিনের পর দিন অবস্থান করতেন।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগখ্যাত পিছিয়ে পড়া কুড়িগ্রাম জেলাকে এগিয়ে নিতে এবং জেলাবাসীর প্রাণের দাবি পূরণে তিন বছর আগে ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিলমারী সফরে আসেন। পরে নতুন করে চিলমারী বন্দর চালুর ঘোষণা দেন তিনি। সেই মাসের ২৩ সেপ্টেম্বর চিলমারীর রমনা ঘাট নামক স্থানে পন্টুন স্থাপন করে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) চিলমারী নদী বন্দর উদ্বোধন করেন তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান।
ঐতিহাসিক চিলমারী নৌ-বন্দর চালুর সরকারি ঘোষণার তিনবছরে নানা প্রতিবন্ধকতায় নৌ-বন্দরটির অবকাঠামো বা অন্যকোনো কার্যক্রম বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি হয়নি। অবশেষে অতি সম্প্রতি নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী কয়েক দফা কুড়িগ্রাম সফর ও চিলমারী বন্দর এলাকা পরিদর্শনকালে জানিয়েছিলেন চিলমারী নৌ-বন্দর আন্তর্জাতিক বন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হবে এবং দ্রুত এর কার্যক্রম শুরু হবে।
চিলমারী নদী বন্দরের উন্নয়নের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার লাভের মাধ্যমে এই অঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে। পাশাপাশি চিলমারী নৌ-বন্দরটি আগের অবস্থায় ফিরে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।
চিলমারী উপজেলা চেয়ারম্যান শওকত আলী সরকার (বীরবিক্রম) বাংলানিউজকে বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে কলকাতা থেকে গৌহাটি এবং আসামের ধুবড়ী পর্যন্ত নৌ-যাতায়াত ছিলো। সেই সময় বিআইডব্লিউটিএ সেখানে পাইলট বিট ও এসএসবি স্টেশন স্থাপন করে। চিলমারী বন্দরটি একসময় সারাবিশ্বে পরিচিত ছিলো, ছিলো বেশ নাম ডাক। কিন্তু ভাঙন আর উদ্যোগের অভাবে ধীরে ধীরে বিলিন হয়ে যায়। তবে, কালের বিবর্তনে এবং নদী ভাঙনসহ নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে চিলমারী বন্দরটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বন্দর কেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ ব্যবসা বাণিজ্যিক কার্যক্রমে স্থবির হয়ে পড়ে।
দেশের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা গতিশীল করতে পুনরায় চিলমারী বন্দরটি সচল করার ঘোষণা দেন। এটি বাস্তবায়ন হলে ঐতিহাসিক চিলমারী বন্দর আবারও ফিরে পাবে তার অতীত ঐতিহ্য। ঘুচবে এলাকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, কর্মসংস্থান হবে হাজার হাজার মানুষের।
বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক মো. শফিকুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ইতোমধ্যে বন্দরের কার্যক্রম ও উন্নয়ন নিয়ে আমরা নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী চিলমারী বন্দর পরিদর্শন করে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন-এটি আন্তর্জাতিক নৌ-রুট হিসেবে ব্যবহৃত হবে। চিলমারী বন্দর বাস্তবায়নের জন্য নেওয়া প্রকল্পটি একনেকে পাস হলেই বন্দরের কার্যক্রম শুরু হবে। আমরা সচেষ্ট রয়েছি, চিলমারী নদী বন্দরটি দ্রুত চালু হোক এবং এলাকার উন্নয়ন ঘটুক।
বাংলাদেশ সময়: ১০০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৬, ২০২০
এফইএস/এএটি