ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

বিটুমিন নিয়ে রহস্য!

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১১ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০২০
বিটুমিন নিয়ে রহস্য!

দেশের ভৌত অবকাঠামো বিশেষত সড়ক নির্মাণে একটি অপরিহার্য উপকরণ বিটুমিন। দেশে চাহিদার এক দশমাংশ বিটুমিন উৎপাদন করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। অবশিষ্ট বিটুমিন আমদানি করেই চাহিদা মিটিয়ে থাকেন ব্যক্তি উদ্যোক্তারা। বিটুমিনের দুইটি গ্রেড থাকলেও উচ্চমানের ‘৬০-৭০’ গ্রেডের বিটুমিন নিয়ে যেমনটি রয়েছে রহস্য, তেমনটি সমালোচনারও কমতি নেই। বিটুমিন উৎপাদন ও বিপণনে অনৈতিক লেনদেনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগও রয়েছে। তবে কোনো পক্ষই এসব অভিযোগের দায় নিতে রাজি নয়।

সাধারণত, স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী বিভাগ (এলজিইডি) এবং সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ সড়ক নির্মাণের জন্য বিটুমিন ব্যবহার করে থাকে।

আমাদের দেশে বছরে ৬ লাখ টনের অধিক বিটুমিনের প্রয়োজন পড়লেও ইস্টার্ন রিফাইনারি উৎপাদন করে ৬০-৭০ হাজার মেট্রিক টন।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর এলজিইডি পুরো বছরের জন্য ১ লাখ ৮৪ হাজার টন বিটুমিনের চাহিদা দিয়ে পত্র দেয় বিপিসিকে। জানুয়ারি মাসে দেওয়া মাসওয়ারি চাহিদা পত্রে তিন মাস আগের চাহিদা উল্লেখ করা নিয়েও সমালোচনা তৈরি হয়েছে। এদিকে ইস্টার্ন রিফাইনারি বলছে উৎপাদনের পর ৬-৭ দিন পর্যন্ত স্টোরেজ করা যায়। আবার সড়ক ও জনপথ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বারংবার গরম ও ঠাণ্ডা করার ক্ষেত্রে বিটুমিনের মান কমে যায়। এতে আমদানিকৃত বিটুমিনের ব্যবহার নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সমালোচনা আছে, আমাদের দেশের বেশিরভাগ সড়কই নষ্ট হয় নিম্নমানের বিটুমিনের কারণে।

জ্বালানি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৯ হাজার ৮৭৭ মেট্রিক টন বিটুমিন উৎপাদন করে ইস্টার্ন রিফাইনারি। তন্মধ্যে ৬৬ হাজার ৪৪৮ মেট্রিক টন বিটুমিন বিক্রয় করে বিপিসি। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিপিসিতে বিক্রয়ের চাহিদা রয়েছে ৬০ হাজার মেট্রিক টন বিটুমিন। ইস্টার্ন রিফাইনারি ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ১ মার্চ ইস্টার্ন রিফাইনারিসহ চার বিতরণ কোম্পানিতে সবমিলিয়ে বিটুমিনের মজুদ ছিল ১২ হাজার ৭৪৩ টন। যদিও বছরের শুরুতে (গত ১ জানুয়ারি) মজুদ ছিল ১১ হাজার ৩৬৬ টন বিটুমিন।

তথ্য অনুযায়ী, ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ২৮১৩ টন, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানিতে ২৩৬ টন, পদ্মা অয়েল কোম্পানিতে ৩৩৮৯ টন, যমুনা অয়েল কোম্পানিতে ৩২৪৫ টন এবং মেঘনা পেট্রোলিয়ামে মজুদ ছিল ৩০৬০ টন বিটুমিন মজুদ রয়েছে।

এদিকে বিপিসির বিতরণ কোম্পানিগুলোতে বিটুমিনের মজুদ বেড়ে যাওয়ার কারণে চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি বিটুমিনের দাম কমিয়েছে বিপিসি। ড্রামের ক্ষেত্রে ১৫০ কেজির প্রতি ড্রামে ৫শ টাকা এবং বাল্কে প্রতি টনে ৩৩শ টাকা কমিয়েছে বিপিসি। বর্তমানে ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন প্রতি ড্রাম ৮৫০০ টাকা এবং ৬০-৭০ গ্রেডের মূল্য ৮৯০০ টাকা।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) চট্টগ্রাম বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জুলফিকার আহমেদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘দুই ধরণের বিটুমিন রয়েছে। ইস্টার্ন রিফাইনারি ৮০-১০০ উৎপাদন করলে তো বিক্রয় হবে না। আমাদের প্রয়োজন ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন। বাজারে যেটি চলছে সেটি না বানিয়ে অন্যটা বানিয়ে ফেললে তাতো চলবে না। বর্তমানে সড়ক ও জনপথ রাস্তা নির্মাণে ৮০-১০০ বিটুমিন ব্যবহার করে না। আমদানিকৃত বিটুমিনের চেয়ে ইস্টার্ন রিফাইনারির বিটুমিনের মান অনেক উন্নত। যে কারণে প্রাইভেট কোম্পানির বিটুমিন আমরা ঠিকাদারদের কনসিডার করি না। ’

জানা যায়, গত ১৫ জানুয়ারি এক লাখ ৮৪ হাজার টন বিটুমিনের চাহিদা উল্লেখ করে বিপিসিকে চিঠি দেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) সুশংকর চন্দ্র আচার্য্য স্বাক্ষরিত ওই পত্রে গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসের চাহিদা উল্লেখ করা নিয়েও সমালোচনা তৈরি হয়েছে। চাহিদার পুরোটাই ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন উৎপাদন কিংবা আমদানির অনুরোধ করা হয়।

কিছুটা ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায় এলজিইডি চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ওয়াহিদুজ্জামানের বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘আমরা ৮০-১০০ ও ৬০-৭০ গ্রেড দুটোই ব্যবহার করি। দুটোই ভাল। মেনটেনেন্স কাজের জন্য ৬০-৭০ ব্যবহার করছি। ইম্প্রুভমেন্ট কাজের জন্য ৮০-১০০ ব্যবহার করি। আগের কন্টাক্টগুলোতে আমরা ৮০-১০০ গ্রেডই ব্যবহার করি। নতুন অর্থবছর থেকে ৬০-৭০ গ্রেড ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে আগে যেসব চুক্তি ছিল সেগুলোতে ৮০-১০০ ব্যবহার করা হচ্ছে। ’ 

তিনি বলেন, বিটুমিন হতে হয় আবহাওয়া উপযোগী। না হলে অল্পতেই নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের দেশের ৮০-১০০ গ্রেড বিটুমিনও অনেক ভাল। ’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সড়ক ও জনপথ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রাইভেট আমদানিকারকরা বিপিসির লোকজনকে অনৈতিক সুবিধা দেয়। এতে তারা অপ্রয়োজনীয় বিটুমিন তৈরি করে। ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন এখন কেউ ব্যবহার করে না। ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন প্রাইভেট আমদানিকারকরা বাল্কে নিয়ে আসে। তারপর গরম করে ট্যাংকে নেয়। বিক্রির সময় আবার গরম করে। কয়েক স্তরে গরম ও ঠাণ্ডা হওয়ার কারণে মান কমে যায়। বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন এক প্রতিষ্ঠানও বিটুমিন আমদানির সাথে জড়িত। অনেকক্ষেত্রে তারাই বিপিসির কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বিটুমিনের দাম বাড়িয়ে নেয়। বিপিসির বিটুমিনের দাম বাড়তি থাকলে আমদানিকৃত বিটুমিনের দামও ভাল পাওয়া যায়। এতে প্রাইভেট আমদানিকারকরা লাভবান হয়। ’

তবে উল্টো অভিযোগও রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইস্টার্ন রিফাইনারি ও বিপিসির কয়েক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের দেশে বিটুমিনের মূল ব্যবহারকারী এলজিইডি ও সড়ক জনপথ। তাদের প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে প্রাইভেট কোম্পানি থেকে বিটুমিন নেয়। ইস্টার্ন রিফাইনারিতে উৎপাদিত বিটুমিন উচ্চমানসম্পন্ন। ইস্টার্ন রিফাইনারির বিটুমিন ব্যবহার করলে সড়ক নষ্ট হওয়ার কথা নয়। আমদানিকৃত বিটুমিন ব্যবহারের কারণেই বছর না পেরুতেই দেশের সড়কগুলো নষ্ট হয়ে পড়ছে। আবার আমদানিকৃত বিটুমিন পরীক্ষা করাও হয় না। ’

এ বিষয়ে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্লানিং এন্ড শিপিং) মো. মোস্তাফিজার রহমান বলেন, ‘৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন উৎপাদন করে ট্যাংকে ৬-৭ দিনের বেশি রাখলে জমে যায়। জমে গেলে ফিলিং করা যায় না, ট্রান্সফারও করা যায় না। যে কারণে প্রয়োজনের এক সপ্তাহে আগে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিলে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা চাহিদা দিলে আমরা উৎপাদন করি। ’ 

তিনি বলেন, আমাদের ১৮ হাজার ড্রাম স্টোরেজ সক্ষমতা রয়েছে। এরপর ব্যারেল ফিলিং করা যায় না। জানুয়ারি থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ৮০-১০০ বিটুমিন তৈরি করা হচ্ছে না বলেও জানান তিনি।

সূত্র: দৈনিক আজাদী

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০২০
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।