ইতোমধ্যে এসএমই, কৃষি, গার্মেন্টস ও শিল্পখাতের ব্যবসা-বাণিজ্যের ধস ঠেকাতে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এই প্রণোদনা প্যাকেজ শিল্পখাতকে রক্ষার জন্য যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।
ইতোমধ্যে প্রায় সব ধরনের শিল্পঋণের কিস্তিও ৩০ মে পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। অর্থাৎ ৩০ মে এরপর বকেয়া কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। যা এই মুহূর্তে সাময়িক স্বস্তিকর হলেও এটা স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। এজন্য সরকারের এই পলিসির পাশাপাশি শিল্পখাতকে রক্ষায় চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফ করার দাবি জানিয়েছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।
সুদ মওকুফ করা হলে শিল্পখাতের বিপর্যয় ঠেকানো সহজ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যবসায়ী, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সমন্বিতভাবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন নীতি নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছেন শিল্পখাত সংশ্লিষ্টরা।
শিল্পোদ্যোক্তারা মনে করেন, শিল্পখাতকে রক্ষার জন্য ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফ করলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তি আসবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এজন্য সরকার চাইলে করপোরেট করও কমিয়ে দিতে পারে। আবার সুদ বাবদ কিছুটা ভর্তুকিও দিতে পারে। অর্থাৎ সুদের একটা অংশ সরকার নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিতে পারে। বাকিটা ব্যাংকগুলো মওকুফ করতে পারে। এতে করে ব্যাংকগুলোর যেমন মুনাফা কমবে না। তেমনি কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটবে না শিল্প কিংবা ব্যাংকখাতে। এক তরফাভাবে ব্যাংক ঋণের সুদ দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে করোনা পরবর্তী সময়ে হয়তো অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে জনবল কমিয়ে আনার কথা ভাববে। অনেকেই হয়তো এই ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে টিকতেই পারবে না। আবার ব্যাংকগুলোর ব্যবসা ভালো না হলে তারাও জনবল কমিয়ে আনার কথা চিন্তা করতে পারে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব সেক্টরকে বাঁচাতে হলে একটি সমন্বিত পলিসি গ্রহণ করতে হবে। এর ফলে শিল্পোদ্যোক্তারাও বাঁচবেন আবার ব্যাংক কর্তৃপক্ষও মুনাফা করতে পারবেন। একইভাবে কোনো শিল্প বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো সিদ্ধান্ত থেকেও বিরত থাকবে। এতে সারা দেশের অর্থনীতিও সচল থাকবে বলে তারা মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের (ডিসিসিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানির পরিচালক আবুল কাশেম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখন এমন একটা পরিস্থিতি বিরাজ করছে যে, কেউই ভালো নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পোদ্যোক্তা, সাধারণ মানুষ সবাই সংকটে রয়েছেন। তবে শিল্পখাতের উদ্যোক্তারা চরম উদ্বিগ্নতায় দিন কাটাচ্ছেন। একদিকে জনজীবন বিপর্যস্ত। অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। কিন্তু ব্যাংক ঋণের সুদ তো আর থেমে নেই। কিস্তি স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু সেটা তো পরবর্তী সময়ে দিতেই হবে। ফলে এটা সাময়িক স্বস্তিদায়ক হলেও দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমাধান নয়। এক্ষেত্রে সরকার চাইলে একটা সমন্বিত পলিসি নিয়ে সুদ বাবদ কিছু ভর্তুকি দিতে পারে। তাহলে শিল্প মালিকদের ওপর চাপ কিছুটা হলেও কমে আসবে। আবার একটা এসআরও জারি করে করপোরেট ট্যাক্সও কমিয়ে দিতে পারে। চাইলে ব্যাংকের সুদ বাবদ ভর্তুকিও দিতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশে কিন্তু পরিস্থিতি সামলাতে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কেননা ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে হলে সরকার ঘোষিত প্রণোদনার বিকল্প কিছুও ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের পুরো সুদ মওকুফ করা হলে ব্যাংকের ব্যবসার মুনাফা কমে যাবে। কেননা ব্যাংক চালানোও তো এক ধরনের ব্যবসা। তাদের তো আমানতের সুদ দিতে হয়। কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতে হয়। ফলে এখানে সরকার চাইলে ভর্তুকি দিয়ে সহায়তা দিতে পারে। আবার শিল্প ও ব্যাংক খাতের জন্য করপোরেট ট্যাক্স কমিয়ে দিতে পারে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো চাইলে তাদের ভালো গ্রাহকদের বেছে বেছে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে সুদ ছাড় দিতে পারে। তবে এসবের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে। আবার সরকারেরও নীতিগত অনুমোদন প্রয়োজন হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপর্যয় ঠেকাতে হলে এটা আরও গভীরভাবে সরকারকে ভাবতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে করোনার প্রভাবে ইতোমধ্যেই দেশের বেসরকারি খাতে ঋণের গতি কমে গেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত আট মাস ধরেই টানা কমছে এ খাতের ঋণ। করোনা ভাইরাস সংক্রমণে রাজস্ব আয় কমে যাওয়ায় ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ বৃদ্ধি ও আগামী এপ্রিল থেকে এক অঙ্কের সুদহার কার্যকরের প্রভাবে চলতি মার্চে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি আরও কমবে বলে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও ২৫ মার্চের পর বাংলাদেশ ব্যাংক শিল্প খাতের ঋণের তথ্য ওয়েবসাইটে আর হালনাগাদ করেনি। চলতি এপ্রিলে এই প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক পর্যায়ে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে বেসরকারিখাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৮৯৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯ লাখ ৭০ হাজার ৩৪৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অথচ করোনার কারণে এটা এখন নেতিবাচক পর্যায়ে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু অর্থবছরের গত আট মাসে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার অনেক নিচে অবস্থান করছে। চলতি জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ২ শতাংশ, যা আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। গত বছর নভেম্বরে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর ফেব্রুয়ারি-২০২০ শেষে এটা নেমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশে।
এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহ সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ বলেন, প্রত্যেকটি খাতেই বিপর্যয় নেমে এসেছে। তবে শিল্প খাতের সংকটটা হয়তো দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেবে। খাদ্য ও পরিবহন খাতও সংকটে পড়েছে। খাদ্য সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংক ঋণের সুদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত মওকুফ হওয়া দরকার। অন্যথায় ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। কেননা করোনার প্রভাব দীর্ঘায়িত হবে। ইউরোপ-আমেরিকার মতো সুদ মুক্ত সুবিধা আমাদের ব্যবসায়ীরা পেলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। কারণ-ব্যবসায়ীরা যাতে ঋণ খেলাপি না হন, সেটা দেখতে হবে। এই বৈশ্বিক মন্দায় যাদের খাদ্য মজুদ থাকবে, তাদের অর্থনীতিতে ধাক্কা কম হবে বলেও মত দেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, যেকোনো সংকট মোকাবিলায় সরকারকে নীতিগত সহায়তা দিতে হয়। আবার আর্থিক প্রণোদনারও প্রয়োজন পড়ে। এবারের যে সংকট এটা একটা মহামারি। বৈশ্বিক সমস্যা। এটা সব খাতকেই বিপর্যস্ত করেছে। সারা বিশ্বই বিপর্যস্ত। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিপর্যয় ঠেকাতে সরকারের উচিত হবে পলিসি সহায়তার পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা দেওয়া যায় কিনা, সেটা ভেবে দেখা। তবে সুদ মওকুফের বিষয়টা বেশ জটিল। এটার সঙ্গে ব্যাংকের ব্যবসাও জড়িত। তবে করপোরেট ট্যাক্স কমিয়ে আনতে পারে সরকার। চাইলে এর পাশাপাশি সুদবাবদ ভর্তুকিও দিতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০২০
এএটি