অন্যদিকে মৌসুমের শুরুতে ঘের পরিচর্যা শেষ করলেও চাহিদা অনুযায়ী পোনা ছাড়তে না পাড়ায় এক মৌসুম মার খেয়ে যাচ্ছেন তারা।
এছাড়া বর্তমানে হ্যাচারির পোনা উৎপাদন ব্যাহত ও পরিবহন ব্যবস্থা অচল থাকায় পোনা সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।
চিংড়ি চাষি ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাগেরহাট জেলায় ২৫০ কোটি বাগদা ও ২ কোটি গলদা চিংড়ির রেনুর চাহিদা রয়েছে। করোনার প্রভাবে বাগদা চিংড়ির হ্যাচারিতে উৎপাদন সীমিত হওয়ায় সব চাষি তার চাহিদা অনুযায়ী মাছ ছাড়তে পারবেন না। যেসব হ্যাচারির মাছ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে তাও ক্রয় করতে হচ্ছে অতিরিক্ত দামে।
অন্যদিকে বাগেরহাটে থাকা ১৪টি গলদা চিংড়ি হ্যাচারির সবগুলোতেই উৎপাদন বন্ধ থাকায় প্রাকৃতিক উৎসের ওপর নির্ভর করতে হবে গলদা চাষিদের। যার ফলে গলদা চিংড়ি চাষিরাও পোনা সংকটে ভুগছেন। গেল বছরের তুলনায় এ বছর গলদার উৎপাদন ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কমে যাবে বলে দাবি করেছেন একাধিক কৃষক। বাগদা চিংড়ির উৎপাদনও কমবে আশঙ্কাজনক হারে। ফলে জেলার হাজার হাজার কোটি টাকা আয় কমে যাবে।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশের মধ্যে সব থেকে বেশি চিংড়ি উৎপাদন হয় বাগেরহাট জেলায়। বর্তমানে সরকারি হিসেবে বাগেরহাট জেলায় ৬৬ হাজার ৭১৩ হেক্টর জমিতে ৭৮ হাজার ৬৮৫টি বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। এসব ঘেরে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ১৬ হাজার ৫৭৫ মেট্রিকটন বাগদা ও ১৫ হাজার ৪১৩ মেট্রিকটন গলদা চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে। তবে বেসরকারি হিসেবে এর পরিমাণ আরও বেশি।
বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেম ইউনিয়নের চিংড়ি চাষি মো. মহিবুল্লাহ মিন্টু বলেন, আমার ১২শ বিঘা জমির ৩টি ঘেরে গেল বছর প্রায় ৯০ লাখ বাগদার পোনা ছেড়েছিলাম। এ বছর মাত্র ১৫ লাখ পোনা ছাড়া হয়েছে। এবার পোনা সংকটের কারণে গত বছরের তুলনায় হাজার প্রতি ৬শ টাকা বেশি দিয়ে পোনা কিনতে হচ্ছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী পোনা ছাড়া সম্ভব হচ্ছে না।
এছাড়া রপ্তানি বন্ধ থাকায় স্থানীয় বাজারে কম দামে বাগদা চিংড়ি বিক্রি করতে হচ্ছে। মাছ রপ্তানিকারক কোম্পানিতে সাইজ ভেদে যে মাছ ৮শ থেকে ১২শ টাকায় বিক্রি করতাম। সেই মাছ স্থানীয় বাজারে মাত্র ৫শ থেকে ৬শ টাকা বিক্রি করতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে চিংড়ি চাষ আমাদের গলার কাটা হয়ে দাঁড়াবে।
বাগেরহাট সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের চিংড়ি চাষি আব্দুস সোবহান বলেন, প্রতিবছর চৈত্র মাসের প্রথম দিক থেকেই আমরা ঘেরে পোনা ছাড়ি। কিন্তু এবছর সময়মত পানি ও পোনা না পাওয়ায ঘেরে পোনা ছাড়তে পারিনি। পোনা ছাড়ার মৌসুমের শেষ পর্যায়ে এসে অতিরিক্ত দামে পোনা ছাড়তে হচ্ছে। তাও চাহিদা অনুযায়ী পোনা ব্যবসায়ীরা পোনা দিতে পারছে না আমাদের। গত বছর এই দিনে যে গলদা রেনুর হাজার ছিল ১৬-১৭শ টাকা, সেই রেনু পোনা এখন কিনতে হচ্ছে ২৫ থেকে ২৬শ টাকা করে। এত দামের পোনা ছেড়ে বেশি দামের খাবার খাইয়ে পুঁজি উঠবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান আছি।
কচুয়া উপজেলার কামরুল ইসলাম বলেন, হ্যাচারি থেকে বাগদার পোনা ৫ থেকে ৬শ টাকা হাজার কিনতে হচ্ছে। গেল বছর এই পোনা ক্রয় করা পড়েছে মাত্র ২ থেকে ৩শ টাকা। এছাড়া নদী থেকে আহরিত বাগদার পোনারও দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। যে পোনা আমরা ৮শ থেকে ১২শ টাকা হাজার কিনেছি। সেই পোনা এবার কিনতে হচ্ছে ১৭ থেকে ২ হাজার টাকা হাজার করে।
বাগেরহাট জেলা চিংড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ফকির মহিতুল ইসলাম সুমন বলেন, গেল দুই-তিন বছর বৈরী আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে জেলায় মোট চিংড়ির উৎপাদন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমে গেছে। বর্তমানে কোভিড-১৯ মরার উপর খারার ঘা’র মত দেখা দিয়েছে চাষিদের কাছে। ফলে চাষিরা ঘেরে থাকা বিক্রয়যোগ্য মাছ উপযুক্ত দামে বিক্রি করতে পারছেন না। আবার পোনার অভাবে নতুন মৌসুমে মাছও ছাড়তে পারছেন না।
বাগেরহাট জেলায় প্রায় আড়াই থেকে তিনশ কোটি বাগদার পোনা ও দেড় থেকে দুই কোটি গলদা চিংড়ি পোনার চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এ বছর নানা কারণে তিন ভাগের এক ভাগ পোনাও পাওয়া যাচ্ছে না। যতদিন পর্যন্ত হ্যাচারিগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণ গলদা ও বাগদা চিংড়ির পোনা উৎপাদন করতে না পারবে, ততদিন পর্যন্ত প্রাকৃতিক উৎস্য থেকে পোনা আহরণের অনুমতি দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান মৎস্যচাষিদের এই নেতা।
রামপাল উপজেলার ফয়লাহাট চিংড়ি পোনা মৎস্য আড়তদার সমিতির সভাপতি কাজী রাশেদুল ইসলাম ডালিম বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সব থেকে বড় পোনা বিক্রির মোকাম ফয়লাহাট। ঘেরে চিংড়ির পোনা ছাড়ার মৌসুমে প্রতিদিন এখানে কোটি কোটি টাকার পোনা বিক্রি হয়। কিন্তু এ বছর পোনার সরবরাহ কম থাকায় বাজার এক ধরনের যৌলুশ হারিয়ে ফেলেছে।
এভাবে চলতে থাকলে বাজারের দুই শতাধিক ব্যবসায়ী ও এ অঞ্চলের চাষিরা বিপাকে পরবেন বলে দাবি করেন তিনি।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. খালেদ কনক বলেন, খাল খননের ফলে ঘেরে পানি নেই। বিক্রয়যোগ্য মাছের দাম নেই। বাজারে পোনা সংকট। বাগেরহাটে প্রায় দেড় কোটির মত গলদা পোনার চাহিদা রয়েছে। এ বছর ২৫ থেকে ৩০ লাখ পোনা বাজারে পাওয়া যাবে। কোনোভাবেই পোনার চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। তবে মহামারি থেকে দেশ পরিত্রাণ পেলে চাষিদের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৪ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০২০
আরএ