এমন পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে ইতিবাচক তথ্য দিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট।
একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে তারা বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি চীন ও ভারতের চেয়েও নিরাপদ অবস্থানে আছে।
বিশ্বব্যাপী নির্ভরযোগ্য এ গণমাধ্যমের এই প্রতিবেদন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা।
আরও পড়ুন: ভারত-চীনের চেয়েও নিরাপদ বাংলাদেশের অর্থনীতি: দ্য ইকোনমিস্ট
দ্য ইকোনমিস্টের গবেষণা সম্পর্কে তারা বলছেন, কয়েকটি সূচকের ওপর গবেষণা করে দেশের সার্বিক অর্থনীতির বিষয়ে বলা যাবে না। এটা যথার্থ নয়। শুধু ঋণনির্ভর নয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ ব্যবসায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, যা অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। তবে চলমান পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত না হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি নেগেটিভ গ্রোথে যাবে না বলেও মনে করেন তারা।
এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি এই গবেষণাকে কোনো দাম দেই না। এটিতে তারা অত্যন্ত লিমিটেড ক্রাইটোরিয়া নিয়ে এসেছে এবং সেটা হচ্ছে মূলত ডেথ সার্ভিসিং ক্যাপাসিটি অর্থাৎ বিদেশ থেকে সরকারের যে ঋণ আছে সেটাকে সার্ভিস করার বিষয়ে এবং সেটার জন্য বাংলাদেশের রিজার্ভ ভাল আছে। এ কারণে তারা বলছে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এটা তো হচ্ছে অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে। ভবিষ্যৎতে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রচণ্ড ঝুঁকি আছে। কেননা রপ্তানিতে ধস নেমেছে, রেমিটেন্সে ধস নেমেছে। সুতরাং আর্থিক বহির্খাত বড় সমস্যায় এবং আভ্যন্তরীণ উৎপাদন, পরিবহন ইত্যাদি ব্যাহত হচ্ছে। নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মারাত্মকভাবে। তবে কথা হচ্ছে ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, চীন ও নেপালের চাইতে একটু বেটার হতে পারে। ইন্ডিয়া হয়তো নেগেটিভ গ্রোথে চলে যেতে পারে। আমরা হয়তো নিগেটিভ গ্রোথে যাবো না। তবে এধরনের রিপোর্ট বিভ্রান্তমূলক। ’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে লকডাউন বাড়লে ঝুঁকি বাড়বে। অর্থনীতির ওপর আরো চাপ সৃষ্টি হবে। আশা করি এটি যদি মাসখানেকের মধ্যে শেষ হয়, তাহলে আমরা নেগেটিভ গ্রোথে যাবো না। ’
তারা প্রতিবেদন দিয়েছে একটি পারসেন্টিসের ওপর। চায়নার ইকোনোমি অনেক উন্নত। আমাদের যে লেভেল সেটা অনেক নিচে। সেই তুলনায় ওদের চেয়ে আমাদের অর্থনীতি ভালো থাকবে। এমনটা দাবি করেছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘দ্য ইকোনমিস্ট যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেটা টোট্যাল পারসেন্টিসের ওপর। চায়নার ইকোনোমি অনেক উন্নত। আমাদের যে লেভেল সেটা অনেক নিচে। ওদের ওই লেভেলের তুলনায় হয়তো আমাদের অর্থনীতি ভাল আছে বা ভাল থাকবে। তবে ওদের অর্থনীতি বড় হওয়ায় সার্বিকভাবে ওদের ক্ষতি অনেক বেশি হবে। আমরা গরিব দেশ। আমাদের ক্ষতি কম হলেও অসুবিধা বেশি হবে। ’
তিনি বলেন, ‘জিডিপিতে আমরা ভালো অবস্থানে আছি। সরকার যে এক লাখ কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, এগুলোর বিপরীতে যদি উৎপাদন যথাযথ না আসে বা ম্যাচিং না করে তাহলে ইম্প্রেশন হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রণোদনা থেকে আউটপুট আসতে হবে। এটাতো বড় করছে সরকার। এটাতো এমন না যে বাজেট থেকে দিচ্ছে। সরকার এখানে ঋণ করছে তাই এটার বিপরীতে যদি আউটপুট না আসে তাহলে মূল্যস্ফীতি দেখা দেবে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘এজন্য লকডাউন শিথিল করা দরকার যাতে কনজাম্পশন ও উৎপাদন একসাথে চলতে থাকে। তা না হলে জিডিপি কমতে থাকবে। ’
আবু আহমেদ বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি নিরাপদ নয়, আমাদের ক্ষতি অনেক হয়ে গেছে। আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। উৎপাদন এবং কনজাম্পশন যদি চালু করে দেওয়া যায় তাহলে ক্ষতি অতটা মারাত্মক হবে না। অলরেডি চার থেকে ৫ লাখ লোককে মধ্যপ্রাচ্য থেকে চলে আসতে হবে। এতে করে রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যাবে। এতে করে ফরেন রিজার্ভ কমে যাবে। তখন ডলারের দাম বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে সবকিছু মিলিয়ে দুর্বল অর্থনীতির দিকে যাবে দেশ। ’
তিনি বলেন, ‘মানুষ রিলিফ খেয়ে কয়দিন চলবে। সরকারের ভাণ্ডার খালি হয়ে যাবে। এই লোকগুলোকে উৎপাদনের সাথে জড়াতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকানপাট গণপরিবহন চালু করতে হবে অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীর কোথাও কোন দেশে শেয়ারবাজার বন্ধ নেই। আমাদের দেশে শেয়ারবাজার কেন বন্ধ রয়েছে? দেশ একটি অস্বাভাবিক অবস্থায় চলছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে অর্থনীতিতে বড় ক্ষতি হবে। ’
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন নিয়ে এক ধরনের স্বস্তি প্রকাশ করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘ইকোনোমিস্ট পত্রিকা যে চারটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে এই মূল্যায়নটি করেছে তা হলো- দেশীয় দেনা, বিদেশি দেনা ঋণের ব্যয় পরিশোধের মাত্রা এবং রিজার্ভের পরিস্থিতি। সেই বিচারে বাংলাদেশ ৬৬টি উদীয়মান দেশের ভেতরে নবম স্থানে রয়েছে যা বর্তমান পরিস্থিতিতে যথেষ্ট স্বস্তিদায়ক। সাধারণত এ ধরনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে যেটি হয়ে থাকে যে উদীয়মান দেশগুলো এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমদানি ব্যয় মেটাতে হিমশিম খায় অথবা এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের মুদ্রা বিনিময় হারে অবমূল্যায়ন ঘটে এবং তখন তাদেরকে আইএমএফ বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে হয় এবং ঋণের ব্যয়ও বেড়ে যায়। তাই সে দিক থেকে বাংলাদেশের এখন যা পরিস্থিতি তা যথেষ্ট স্বস্তিদায়ক। ’
তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক যে আগামীতে যখন আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাবে তখন কিন্তু এই সূচকগুলোতে আমাদের জন্য স্বস্তির জায়গা থাকবে। আবার কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। এই সাথে এটাও ঠিক আমরা বুঝতে পারছি যে, আমাদের ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট রিলেটেড ইন্ডিকেটরগুলো আমাদের ভালো অবস্থায় রয়েছে। সুতরাং আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার যে যৌক্তিকতা অনেকটাই এই মূহূর্তে নেই। ফলে সরকার এই মুহূর্তে যে ঋণের জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে খুঁজছে সেই দিক থেকে আইএমএফের কাছ থেকে অন্তত ব্যালেন্স অব পেমেন্ট রিলেটেডের জায়গা থেকে যে ঋণ পাওয়া, সেই প্রাপ্তিটা কিন্তু সহজ সাধ্য হবে না। কিন্ত একই সঙ্গে এটাও ঠিক যে এই ধরনের সূচকগুলো ভালো অবস্থানে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক উৎসগুলো বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত হবে না। ’
করোনা ভাইরাসের সংকটময় পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্বের কোন দেশ কতটুকু অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় অবস্থান করছে, তা নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে লন্ডনভিত্তিক গণমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট।
এতে এ বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়েও বাংলাদেশের অর্থনীতি নিরাপদ আছে। এমনকি পাকিস্তান, চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থনীতির চেয়েও কম ঝুঁকিতে বাংলাদেশ।
করোনা ভাইরাসের মহামারি পরিস্থিতিতেও উদীয়মান সবল অর্থনীতি ৬৬টি দেশের। এরমধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। অর্থাৎ নবম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ।
চারটি সম্ভাব্য সংস্থার নির্বাচিত অর্থনীতির দুর্বলতা পরীক্ষা করে এই জরিপ করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে জনগণের ঋণ হিসেবে জিডিপির শতাংশ, বৈদেশিক ঋণ, ঋণের সুদ ও রিজার্ভ কভার।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তা গবেষণা তালিকাটিতে শীর্ষে রয়েছে বতসোয়ানা। আর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ভেনেজুয়েলা। এছাড়া চীনের অবস্থান বাংলাদেশের পরে; ১০ নম্বরে। আর সৌদি আরবের অবস্থান বাংলাদেশের এক ধাপ আগে, অর্থাৎ আটে।
খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদদের গবেষণায় উঠে আসা এই তালিকায় ভারতের অবস্থান ১৮। পাকিস্তানের ৪৩। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ১৭।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১২ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০২০
এসএমএকে/এজে