ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

বগুড়ায় সাদা সেমাইয়ে স্বপ্ন ভেঙেছে সেমাইপল্লির মানুষের

কাওসার উল্লাহ আরিফ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩০ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০২০
বগুড়ায় সাদা সেমাইয়ে স্বপ্ন ভেঙেছে সেমাইপল্লির মানুষের সেমাই রোদে দিচ্ছেন দুই নারী শ্রমিক। ছবি: আরিফ জাহান

বগুড়া: করোনা ভাইরাসের প্রভাবে আর্থিক সংকটে পড়েছেন বগুড়ার সেমাই পল্লিখ্যাত নিশ্চিন্তপুর, বেজোড়া, ঘাটপাড়া, শ্যামলা কাথিপাড়া, শ্যামবাড়িয়া, কালসিমাটি, রবিবাড়িয়াসহ প্রায় ১০টির অধিক গ্রামের সেমাই তৈরির কাজে লিপ্ত থাকা শতশত নারী শ্রমিক ও ব্যবসায়ী।

বগুড়া সদর ও শাজাহানপুর উপজেলায় এসব গ্রামের অবস্থান। গ্রামের সাদা সেমাই তৈরির কারখানাগুলোতে কাজ করেন প্রায় ছয় শতাধিক শ্রমিক।

এসব শ্রমিকের মধ্যে ৮৫ শতাংশই নারী। সংসারে বাড়তি আয়ের আশায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সেমাই কারখানার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখেন ওই গ্রামগুলোর নারী শ্রমিক।

প্রতিবছর ঈদুল ফিতর উপলক্ষে রমজান মাসে সাদা সেমাইয়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে বলে এ সময় এর উৎপাদনও বেড়ে যায়। কিন্তু এবার করোনা সংক্রমণরোধে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংকটময় সময়ে সেমাই উৎপাদনে টানা পড়ে। এতে মর্জিনা, মনোয়ারা, বেগুনি, স্বপ্না, খুশির মতো  অসংখ্যক নারী শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
সেমাই রোদে দিচ্ছেন দুই নারী শ্রমিক।  ছবি- আরিফ জাহান
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রতিবছর এ সময়টায় পাল্লা দিয়ে কাজ করতেন সেমাইপল্লির নারী কারিগররা। খ্যাতির এ সেমাইটা চিকন, রঙটা সাদা থাকলেও এর স্বপ্নটা থাকতো রঙ্গিন। ঈদুল ফিতরের উৎসবকে ঘিরে বরাবরই চিকন সাদা সেমাইয়ে রঙ্গিন স্বপ্নে বিভোর থাকাতো সেমাইপল্লির খেটেখাওয়া নারী শ্রমিকরা।

করোনার প্রভাবে এবার স্বপ্নগুলো যেন তাদের ধরা দেয়নি। এবছর তাদের স্বপ্নে করোনা বাগড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে নেই চাহিদা, সেসঙ্গে ঘুরছে না মেশিন। আর তাই করোনা পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেমাই সরবরাহ করতে পারছেন না কারখানা মালিকরা। তাইতো সীমিত আকারে চলছে সেমাই তৈরির কাজ। সেমাই রোদে দিচ্ছেন দুই নারী শ্রমিক।  ছবি- আরিফ জাহানশনিবার (১৬ মে) বগুড়ার সদর ও শাজাহানপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সেমাইপল্লির কারখানার মালিক ও কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা হলে এমনই তথ্য জানা যায়।

উপজেলার মাদলা ইউনিয়নে বেজোড়া গ্রামটি থেকে চিকন সাদা সেমাইয়ের জন্ম। স্বাধীনতার পর থেকেই এ গ্রামের কয়েকটি পরিবার চিকন সেমাই তৈরি শুরু করেন। তবে সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানা যায়নি। সময়ের ব্যবধানে এ শিল্প বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে এখানকার তৈরি চিকন সাদা সেমাইয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশের নানা প্রান্তে। সারাবছরই কমবেশি করে সাদা সেমাই তৈরি করা হয় গ্রামটিতে। প্রতিবছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহায় রেকর্ড পরিমাণ সেমাই তৈরি করেন কারখানার মালিক-শ্রমিকরা। কিন্তু এবারে তার ব্যতিক্রম ঘটেছে। রমজান শুরুর আগে থেকেই করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সারাদেশের মত বগুড়ার সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গত ২৬ মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক দফায় বাড়িয়ে তা ১৬ মে পর্যন্ত বলবৎ রাখা হয়। এরই মধ্যে বগুড়ায় করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় জেলা প্রশাসন গত ২১ এপ্রিল পুরো জেলাকে লকডাউন বা অবরুদ্ধ ঘোষণা দেন। তবে ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে মানুষের জীবন-জীবিকার কথা চিন্তা করে সরকারের পক্ষ হতে ১০ মে থেকে সারাদেশে বেশ কয়েকটি শর্তে সীমিত পরিসরে দোকান-পাট ও মার্কেট খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়।
সেমাই রোদে দিচ্ছেন নারী শ্রমিক।  ছবি: আরিফ জাহাননিশচিন্তপুর গ্রামের সেমাই কারখানার মালিক সোলায়মান মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, সেমাই কারখানাগুলোতে প্রতিবছরের মতো এবার চিত্রটা ভিন্ন। করোনার কারণে সেমাই উৎপাদন থমকে ছিলো। প্রতিবছর যেখানে রমজানের আগে থেকে কারখানায় প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত চলতো কর্মযজ্ঞ সেখানে সারাদেশসহ বগুড়ায় লকডাউনের কারণে রমজানের মধ্যবর্তিতে এসেও ঘুরছে না মেশিন, সেমাই তৈরির কাজ চলছে সীমিত আকারে।

কারখানার মালিক সোলায়মান মিয়া বলেন, যেহেতু ১০ মে থেকে সরকারের সিদ্ধান্তে সীমিত পরিসরে দোকান খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয় সেজন্য নারী শ্রমিকরা ছুটে আসেন কারখানাগুলোতে। আর তাই তখন থেকে সেমাইপল্লির কিছু কারখানা কিছুটা ব্যস্ত হয়ে ওঠে। চিকন সাদা সেমাই তৈরিতে পাড়ায় পাড়ায় শুরু হয় মালিক ও কারিগরদের কর্মযজ্ঞতা।  
সেমাই ঝুঁড়িতে তুলছেন নারী শ্রমিক।  ছবি: আরিফ জাহানতিনি আরও বলেন, বিগত বছরে তার কারখানায় কাজ করছেন ১৪-১৮ জন নারী শ্রমিক। সেমাইয়ের চাহিদা না থাকায় এবার কাজ করছেন ৬ জন শ্রমিক।

এর আগে তার কারখানায় ৫০ কেজি ওজনের ৩৫০ বস্তার মতো ময়দার সেমাই তৈরি হতো। এবছর সেখানে মাত্র ৫০ বস্তা ময়দার সেমাই তৈরি হচ্ছে।

বেজোরা গ্রামের কারখানা মালিক রশিদ আকবর বাংলানিউজকে বলেন, এবছর সেমাই কারখানা খোলার কোনো সিদ্ধান্তই ছিলো না। যেহেতু বেশিরভাগ নারী শ্রমিকরা এ কাজে নিয়োজিত, তাদের সংসার চালানো ও ঈদের খরচ এ কাজের পয়সাতেই হয় তাই তাদের কথা চিন্তা করে ও তাদের অনুরোধেই চালু করা হয়েছে।

তিনি বলেন, কিন্তু যেহেতু ঈদ পর্যন্ত পরিবহন বন্ধ থাকবে এ কারণে সেমাই জেলার বাইরে বিক্রিতে সংশয় রয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বগুড়ার উৎপাদিত সাদা সেমাই স্ব-জেলাসহ উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর, সৈয়দপুর, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হতো।
সেমাই বানাচ্ছেন নারী শ্রমিক।  ছবি- আরিফ জাহানসেমাইপল্লির মর্জিনা, মনোয়ারা, বেগুনি, স্বপ্না, খুশিসহ একাধিকা নারী শ্রমিক (কারিগর) বাংলানিউজকে জানান, তারা সারাবছরই সেমাই কারখানায় কাজ করেন। তবে প্রত্যেক বছরের ঈদের আগ মুহূর্তে বিশেষ করে রমজানের কিছুদিন আগে থেকে এ পেশার সঙ্গে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক যুক্ত হন। ঈদের সময় প্রতিটি কারখানায় কয়েকগুণ উৎপাদন বেড়ে যায়।

তারা জানান, এবছর করোনা তাদের অভাবের সংসারের বাতি যেন নিভু নিভু করে দিয়েছে। একেতো অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলে সংসার তার মধ্যে কাজ নেই, সেমাইয়ের উৎপাদন নেই তাই পয়সাও নেই।

তারা আরও জানান, প্রত্যেকটা কারখানায় তাদের পারিশ্রমিক আসে সেমাই তৈরির ওপর। তারা নারীরা দলবদ্ধভাবে কারখানাগুলোতে কাজ করেন। এক বস্তা ময়দার সেমাই বানিয়ে তারা পারিশ্রমিক পান ১০০ টাকা।

কারখানার মালিকরা জানান, বিগত বছরগুলোতে ঈদের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রত্যেক কারখানায় গড়ে ২৫০-৩৫০ বস্তা ময়দার সেমাই তৈরি হতো। এর প্রতিটি বস্তায় ৫০ কেজি ময়দা থাকে। শ্রমিকরা প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ময়দা দিয়ে সেমাই তৈরি করে পারিশ্রমিক পান ১০০ টাকা।

খ্যাতির এ চিকন সেমাই কিনতে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে ব্যাপারীরা বগুড়ায় আসেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০২০
কেইউএ/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।