ঢাকা: দেশের কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত হলেও কোনো প্রভাব পড়েনি খুচরা বাজারের কেনা-বেচায়। কোরবানির তৃতীয় দিনেও চামড়া বিক্রি করতে না পারায় ব্যবসায়ীরা অনেকটাই হতাশ।
সরকারি সিদ্ধান্তটি আরো আগেই ঘোষণা করা হলে ব্যবসায়ীদের এমন দুর্দশা থাকতো না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, গত ২৯ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে কাঁচা চামড়া রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ চেয়ে ২৯ জুলাই ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিশ্ববাজারে চামড়ার দরপতন ও দেশীয় শিল্পগুলোর সক্ষমতা কমে যাওয়া বিবেচনায় ঢাকার জন্য লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম গরুর প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত বছর ঢাকায় ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
অন্যদিকে, খাসির চামড়া সারাদেশে প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা ও বকরির চামড়া ১০ থেকে ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর খাসির চামড়া ১ থেকে ২০ টাকা ও বকরির চামড়া ১৩ থেকে ১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
সোমবার (০৩ আগস্ট) রাজধানীর পোস্তায় ঈদের তৃতীয় দিন গরুর চামড়া সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। আর খাসির চামড়া বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিস মাত্র ১০ টাকায়। চামড়া নিয়ে বসে থাকলেও দেখা মিলছে না ক্রেতার। এতে অনেকটাই হতাশ আর ক্ষুব্ধ মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী ময়মনসিংহের আবুল কালাম। তিনি ট্রাকে করে প্রায় হাজার পিস চামড়া নিয়ে আসছেন।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, সরকার চামড়ার বাজার স্থীতিশীল রাখার জন্য রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। তাতে কোনো লাভ হয়নি। কেউ চামড়ার দাম কয় না। সরকারি সিদ্ধান্ত কোনো প্রভাব ফেলেনি তাদের ভাগ্যে। সব ব্যবসায়ীর চামড়া রপ্তানি করার সুযোগ না থাকায় সুবিধা থেকে বঞ্চিত প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চামড়া রপ্তানির যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা আসলে বাস্তবসম্মত না। এটা শুধু দেশে চামড়ার বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে করা হয়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত অবাস্তব। এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। কে রপ্তানি করবে, কোন দেশে করবে? গোটা বিশ্বই তো মন্দার শিকার করোনার জন্য। এই সিদ্ধান্ত আরো পাঁচ মাস আগে নিলেও কিছু হতো না। কোভিডের কারণে বাজার বন্ধ। যদি কোভিড-১৯ না থাকতো বাজার খোলা থাকতো তাহলে কিছু রপ্তানি করা সম্ভব হতো।
তিনি বলেন, বর্তমানে চামড়ার কোনো চাহিদা নেই। করোনার কারণে সারাবিশ্বেই এক প্রকার লকডাউন চলছে। পাশাপাশি কোরবানি শুধু বাংলাদেশে হয় না সারাবিশ্বেই এ সময়টায় কোরবানি হয়। ফলে সরবরাহ বেড়ে যায়। আর সরবরাহ বেড়ে গেলে দাম কমে যায়। আর কোভিড-১৯ এর কারণে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশের ইতিহাসে কাঁচা চামড়া কোনো সময় রপ্তানি হয়নি। তাই কাঁচা চামড়া রপ্তানি করতে পারবে না।
চামড়া নষ্টের বিষয়ে শাহীন আহমেদ বলেন, এ বছর ছাগলের চামড়া ৩০ শতাংশ ও গরুর চামড়া ১৫ শতাংশের মতো নষ্ট হবে। সব মিলিয়ে গড়ে প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়। এবার একটু বেশি হবে, তবে ৩০ শতাংশের কাছাকাছি কিনা এখনি বলা যাচ্ছে না। এর কারণ হলো মধ্যসত্ত্বভোগীদের হস্তক্ষেপ। চট্টগ্রামে চার পাঁচ হাজার পিস চামড়া নষ্ট হয়েছে। গত বছর আমাদের এক লাখ পিস চামড়া নষ্ট হয়েছিল। চট্টগ্রামের চামড়াটা বেশি নষ্ট হয়। তাই চট্টগ্রাম ছাড়া সব স্থানেই চামড়া ভালো আছে।
এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বাংলানিউজকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে রপ্তানির ঘোষণা দিয়েছে তা আরো আগে দেওয়া উচিত ছিল। এ বছর রপ্তানি না করলে চামড়ার দাম পাবে না। এজন্য আমাদের সব বর্ডার খুলে দিতে হবে। মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ীরা মিলে বিশ্ববাজারে চাহিদা তৈরি করতে এখন থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এখন বাজারে যে সিন্ডিকেট আছে আর বিকল্প হিসেবে একটি রপ্তানি সিন্ডিকেট তৈরি করতে হবে তাহলে বাজারে দাম পাওয়া যাবে। চামড়া রপ্তানি সহজিকরণ করতে হবে। এ বছর গত বছরের মতো চামড়া কম দামে বিক্রি হচ্ছে। আমাদের ধারণা এ বছরও ৩০ শতাংশের বেশি চামড়া নষ্ট হবে।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, সরকার হোয়াইট ব্লু এবং কাঁচা চামড়া রপ্তানি উন্মুক্ত করলেও তার সুফল তাৎক্ষণিক পাওয়া যাবে না। কারণ পুরো বিশ্ব জানে যে বাংলাদেশ থেকে কাঁচা চামড়া কিংবা হোয়াইট ব্লু রপ্তানি হয় না। তাহলে হঠাৎ করেই এ চামড়ার বাজার ধরা সহজ হবে না। এছাড়া করোনার জন্য বিশ্ব বাজারে স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন বলেন, ‘চামড়া পরিস্থিতির যেকোনো সমস্যা মোকাবিলা করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আগে থেকেই কন্ট্রোল রুম খুলেছে। সেখান থেকে সারাদেশে চামড়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এতে চামড়া সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের গাফিলতির প্রমাণ মিলেছে। এ কারণেই কিছু চামড়া নষ্ট হয়েছে। ’
কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা বলছেন, চামড়া খাতে ট্যানারি মালিকদের একচেটিয়া মুনাফার পথ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত খারাপ হয়নি। তবে, করোনার কারণে সময়োপযোগীও হয়নি। করোনার জন্য বিশ্বব্যাপী এখন অস্থিরতা চলছে। চাহিদা ও দাম দুই কমে গেছে। ইউরোপের দেশ ও চীনের বাজার বন্ধ। এ পরিস্থিতিতে চামড়া রপ্তানির অনুমতি দিলে কী লাভ? এই অসময়ে ক্রাস্ট ও ফিনিশড লেদারেরই যেখানে চাহিদা নেই, সেখানে লবণজাত চামড়া তো কেউ নেবে না। ফলে এ উদ্যোগ শুধু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলেও তারা মনে করেন।
এছাড়া এ বছরও কোরবানির পশুর মধ্যে ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এর কারণ হিসবে তারা বলছেন, সরকারিভাবে চামড়ার অযৌক্তি মূল্য নির্ধারণ, মাঠপর্যায়ে পানির দরে চামড়া কেনা, আড়তে প্রত্যাশিত দাম না পাওয়া, নগদ টাকার সংকট। এছাড়া প্রচণ্ড গরম, বৃষ্টি ও বন্যাকেও তারা দায়ী করছেন।
ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর ১ কোটি ৬৫ লাখ পিস চামড়া থেকে মোটামুটি ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, দুই দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং এক দশমিক দুই শতাংশ ভেড়ার চামড়া। আর এই চামড়ার প্রায় অর্ধেকই পাওয়া যায় কোরবানি ঈদের সময়। এ বছর কোরবানির গরু, ছাড়ল ও মহিষের চামড়া সব মিলিয়ে ৬০ থেকে ৭০ লাখ পিস সংগ্রহ হবে। যা গত বছর হয়েছিল প্রায় এক কোটি। সে হিসেবে এ বছর ৩৫ থেকে ৪০ লাখ পিস চামড়া কম সংগ্রহ হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০৩, ২০২০
জিসিজি/আরএ