ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

হুজুগে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম, এ সপ্তাহেই কমবে

গৌতম ঘোষ,  সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৭ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০২২
হুজুগে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম, এ সপ্তাহেই কমবে

ঢাকা: দেশীয় কৃষকের স্বার্থ বিবেচনায় আমদানি বন্ধ রাখায় আবারো বাড়তে শুরু করেছে পেঁয়াজের দাম। খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজের দাম ১৫ টাকা আর আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

এতে বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা। তবে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত সরবরাহ ও মজুদ রয়েছে। যে দাম বেড়েছে সেটা ভারত থেকে আমদানি বন্ধের হুজুগে বেড়েছে। চলতি সপ্তাহেই দাম কমে আসবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

তবে খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম ৫০ টাকা না হলে আমদানির অনুমতি না দেওয়ার পক্ষে ব্যবসায়ীরা। সরকার অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবে, যাতে কৃষক ও ভোক্তরা স্থস্তিতে থাকে।

ইমপোর্ট পারমিট (আইপি) বন্ধের ঘোষণা সীমিত সময়ের জন্য হলে ভালো। দীর্ঘমেয়াদে ভোক্তাদের কষ্ট দেবে। সরকারকে ভোক্তাদের স্বার্থও দেখতে হবে। এজন্য এক মাস সময় দেখে পরবর্তীতে আবার রিভিউ করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক বাজার বিশ্লেষণ করে সরকারকে নিয়মিত সরবরাহ চেইনে নজরদারি রাখতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহে পর্যবেক্ষণে রাখাসহ সরকারের এ সিদ্ধান্তটা দীর্ঘকালীন না রাখার পরামর্শ দেন তারা।

জানা গেছে, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির জন্য ইমপোর্ট পারমিটের (আইপি) মেয়াদ ছিল ৫ মে পর্যন্ত। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ১ মে থেকে ৬ মে পর্যন্ত ছয়দিন স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ ছিল। বন্দর দিয়ে সবশেষ ৩০ এপ্রিল ৬৮টি ট্রাকে ১ হাজার ৯০২ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। এরপর ঈদের ছুটি শেষে ৭ মে বন্দর দিয়ে আমদানি রপ্তানি শুরু হলেও এখন পর্যন্ত বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রয়েছে। এতে আমদানিকৃত পেঁয়াজের মজুদ কমেছে। ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমায় পেঁয়াজের দাম বাড়তির দিকে রয়েছে।

শনিবার (১৫ মে) রাজধানীর খুচরা ও পাইকারি বাজার ঘুরে জানা গেছে, ঈদের আগে যে ভারতীয় পেঁয়াজ ২৭ থেকে ২৮ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে, আজ রাজধানীর বাজারে তা বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি, যা ঈদের আগে বিক্রি হতো ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে।

রাজধানীর সুত্রাপুর বাজারের খুচরা পেঁয়াজ ব্যবসায়ী বলরাম পোদ্দার বাংলানিউজকে বলেন, বাজারে এখন দেশি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। দেশি পেঁয়াজ ঈদের আগে বিক্রি হতো ২৫ থেকে ৩০ টাকা আর আমদানিকৃত পেঁয়াজ ২৭ থেকে ২৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। মূলত আমদানি বন্ধ থাকায় পাইকারি বাজারে দাম বেড়েছে। এর ফলে খুচরা বাজারেও দাম বেড়েছে।

শ্যামবাজারের মেসার্স নিউ আলী ট্রেডার্সে মালিক শামসুর রহমান বলেন, বর্তমানে পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ রয়েছে। তারপরও বাজারে কোনো সংকট নেই। প্রচুর পেঁয়াজ রয়েছে। সরবরাহও ভালো আছে। পাইকারি বাজারে দেশি পেঁয়াজ ২৬ থেকে ৩০ টাকা। এক সপ্তাহ আগে ২২ থেকে ২৬ টাকায় বিক্রি হতো। এর মধ্যে ৩৪ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়েছে। আজকের বাজার একটু কমতির দিকে। এ সপ্তাহেই দাম কমে আসবে। দেশেই পেঁয়াজ আছে, দাম বাড়ছে শুধু হুতাশে। আগামী দুই মাসে পেঁয়াজের কোনো সংকট হবে না। সরবরাহ ভালো আছে। ৫০ টাকার ওপরে উঠলে তখন সরকার যদি আমদানির অনুমোদন দেয় তবে কৃষক দাম পাবে। সরকার সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তিনি বলেন, আমদানি করা পেঁয়াজ ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যেগুলো বর্ডারে গুদামে ছিল সেগুলো এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। এখন বাজারে ভারতের কিছু পেঁয়াজ রয়েছে। মিয়ানমারসহ অন্যান্য দেশের পেঁয়াজ বন্ধ রয়েছে। বাজারে প্রচুর পেঁয়াজ আছে। কোথাও কোনো ঘাটতি নেই।

এ বিষয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলানিউজকে বলেন, দেশের পেঁয়াজের উৎপাদন স্বস্তির পর্যায়ে ছিল বলেই দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা ছিল এপ্রিল মাসে। আইপি বন্ধের ঘোষণার পর এটা ৪০ থেকে ৪৫ টাকা হয়েছে। সরকারের জন্য যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, যে উদ্দেশ্যে সরকার ঘোষণা দিয়েছে, কৃষক পর্যায়ে প্রণোদনা নিশ্চিত করা; সেটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ একই সাথে ভোক্তাদের বর্ধিতমূল্যের সম্মুখীন না হতে হয়। সেজন্য সরকারকে বাজার নিয়মিত তদারকি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পেঁয়াজের উৎপাদন, মজুদ ও সরবরাহ পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। যদি পর্যাপ্ত মজুদ থাকে তাহলে আইপি বন্ধের একটি সাময়িক প্রতিক্রিয়া আমরা দেখবো। আর যদি পর্যাপ্ত মজুদ না থাকে তাহলে ঊর্ধ্বমুখী প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে।

তিনি বলেন, আমাদের পেঁয়াজের সরবরাহ কমে আসে সাধারণত অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে। সুতরাং সরকার যে ঘোষণা দিয়েছে, সেটা যেন সীমিত সময়ের জন্য হয়। আর উৎপাদনের পর মজুদ পর্যায়ে থাকা অবস্থায় আইপি বন্ধের সিদ্ধান্তটি অব্যাহত রাখা যেতে পারে। সরকার যদি নিয়মিত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে আমদানির প্রয়োজন মনে করে তাহলে করতে পারে। কৃষকদের সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি সীমিত সময়ের জন্য যৌক্তিক বলে মনে করেন সিপিডির এই গবেষণা পরিচালক।

তিনি বলেন, মজুদ পর্যায়ে যদি দাম বেশি থাকে তখন সরকারকে ভোক্তার স্বার্থের কথা বিবেচনা করতে হয়। কেননা অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়ায় ভোক্তা এমনিতে অসহনীয় পর্যায় রয়েছে। এজন্য কৃষক, আড়ত, পাইকারি পর্যায়ে যারা মজুদ রাখে সেখানে ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা যাতে বাড়তি মুনাফা করতে না পারে। আমার পরামর্শ থাকবে, এক মাস সময় দেখে পরবর্তীতে আবার রিভিউ করা। এই সময়ে নিয়মিত সরবরাহ চেইনে নজরদারি রাখা। একই সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে পর্যবেক্ষণে রাখা, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের এ সিদ্ধান্ত দীর্ঘকালীন না রাখা।

এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, পেঁয়াজের বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তারা আমাদের সিদ্ধান্ত জানালে আমরা আপনাদের জানাবো। একটি নির্দিষ্ট দাম হয়ে গেলে সামনে আবার আমদানি পারমিট খুলে দেওয়া হবে। তখন দাম কমে যাবে। আমরা কৃষকদের দামও দিতে চাই, একই সঙ্গে ভোক্তাদেরও সুবিধা দিতে চাই। এ বিষয়টা কঠিন। সামনে কোরবানির ঈদ রয়েছে, সেখানে ব্যাপক পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। আমাদের সরবরাহ ভালো আছে। আমরা চাই আইপি সব সময় খোলা থাকুক। আর কৃষি মন্ত্রণালয় মাঝে মাঝে বন্ধ করে দিতে বলে। সুতরাং তাদেরও হিসাব আছে কখন বন্ধ করলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। সেটা তারা দেখবে।

এ ব্যাপারে কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, আমাদের ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এ বছর আমরা সে পরিমাণ উৎপাদন করেছি। পেঁয়াজ সংরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে। সংরক্ষণে রাখলে ৪০ শতাংশের মতো লস হয়। সে কারণে আমাদের কিছু পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। এদিকে কৃষকরা ভালো ফলন পাওয়ায় দাম পাচ্ছে না। ফলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন আমরা বাজার পর্যালোচনা করে দেখেছি, পেঁয়াজের দাম ৪৫ টাকা করে হয়েছে। আমরা পর্যবেক্ষণে রাখছি, দেখি কী অবস্থা হয়। আমরা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবো। সেখানে কৃষকরা যাতে বাঁচে এবং ভোক্তরাও স্বস্তিতে থাকে।

তিনি বলেন, আমাদের নিয়মিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। আমরা খুব নিবিড়ভাবে বাজার পর্যবেক্ষণ করছি। যদি দেখি দাম বেশি বেড়ে যায় তাহলে আমদানির অনুমতি দেবো। আমরা চাই কৃষকরা যাতে একটু দাম পায়। নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনকেও বলা হয়েছে, অতিরিক্ত দাম যাতে কেউ না নিতে পারে।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০২০-২১ সালে পেঁয়াজের চাহিদা ছিল ৩৫ লাখ টন। চলতি ২০২১-২২ সালের জন্য চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছে ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টন। আগামী বছর এই চাহিদা দাঁড়াতে পারে ৩৬ লাখ টন। এর মধ্যে রমজান মাসে পেঁয়াজের চাহিদা থাকে তিন লাখ টনের ওপরে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ৩৩.৬২ লাখ টন। তাদের হিসাবে, পেঁয়াজের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি ২৫-৩০ শতাংশ। সে হিসাবে নিট উৎপাদন প্রায় ২৩.৫৩ লাখ টন। রান্নার সময় ফেলে দেওয়া অংশ ও নানাভাবে হওয়া অপচয় বাদ দিলে দেশে নিট চাহিদা ২৬ লাখ ৬১ হাজার টন। অর্থাৎ দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি আড়াই থেকে তিন লাখ টন।

২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে পেঁয়াজ চাষের জমির পরিমাণ ৪১ শতাংশ বেড়েছে। ২০১১-১২ সালে দেশে ১.৮০ লাখ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়েছিল। সর্বশেষ গত অর্থবছর দেশে ২.৫৩ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেন কৃষকরা।

এদিকে ২০২০ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করে। ২০২১-২৩ সালের এই রোডম্যাপে পেঁয়াজ ঘাটতি ১১ লাখ টন ধরে উৎপাদন বৃদ্ধির কৌশল নির্ধারণ করা হয়। তাতে পেঁয়াজ ঘাটতির জন্য মানসম্মত বীজের অভাবকে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশে মোট এক হাজার ১০০ টন বীজের প্রয়োজন। সরকারিভাবে পাঁচ-ছয় টন, বেসরকারিভাবে ৫০-৬০ টন পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন করা হয়। বাকিটা কৃষকরা উৎপাদন করে, যা পুরোপুরি মানসম্মত নয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২১  ঘণ্টা, মে ১৫, ২০২২
জিসিজি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।