কিশোরগঞ্জ: রহমত আলী আবুলের এই গল্পটা সত্যি হলেও অনেকটা রূপকথার মতো। অনেক কষ্ট আর সংগ্রামের এক গল্প।
আবুলের বাবা নেই। নেই নিজস্ব জমিজমা এমনকি থাকার জায়গাটুকুও। একটি পোশাক ভিন্ন আর কোনো পোশাকও নেই তার।
মা ভিক্ষাবৃত্তি করে চলেন। আর আবুল পরের বাড়িতে টুকটাক কাজ করে। এভাবে চলে মা-ছেলের নিত্যদিন। রাত কাটে আজ এ বাড়ি, তো কাল ও বাড়ির বারান্দায়।
এদেশে এ রকম আবুলরা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। যে ক’জন পড়াশোনা করে তারাও ঝড়ে পড়ে অকালেই।
কিন্তু আবুল নিজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে টিকে থেকেছে। লড়াইয়ে সে এই সমাজ, নিয়ম আর শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে।
নিজের অদম্য ইচ্ছা আর মেধার জোরে, মায়ের ভিক্ষাবৃত্তির টাকায় এ বছর মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় (এএসসি) আবুল জিপিএ ৫ পেয়েছে।
চলতি বছর মিঠামইন উপজেলার হাজী তায়েব উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বাণিজ্য শাখা থেকে জিপিএ-৫ পায় সে। এ বছর মিঠামইন উপজেলার একমাত্র জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী আবুল।
এর আগে উপজেলার ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুল ও জেএসসিতেও সাধারণ বৃত্তি লাভ করে সে।
স্কুলের নতুন বইখাতা কেনা হয়নি তার। পুরাতন বই ও সহপাঠীদের বই ধার করে চলেছে তার পড়াশোনা। বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি থেকেই এলাকার বিভিন্ন লোকজনের আর্থিক সহযোগিতায় অনেক কষ্ট ও গঞ্জনা সহ্য করে লেখাপড়া করতে হয়েছে তাকে। তবুও দমে যায়নি সে।
সারাদিন ভিক্ষা করে উপজেলার ইসলামপুরে বিভিন্ন বাড়িতে রাত্রি যাপন করেন তার মা। আর আবুল উপজেলা পরিষদ কোয়াটারের বিভিন্ন কর্মকর্তার বারান্দার রুমে রাত্রিযাপন ও লেখাপড়া করে। বিনিময়ে টুকটাক কাজকর্মও করে দেয়।
বই না থাকায় নিয়মিত পড়াশোনায় সমস্যা হয়েছে তার। পরীক্ষার আগে বইয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ ফটোকপি করে লেখাপড়া করতে হয়েছে তাকে। বই খাতা কলমের জন্য অন্যের সহযোগিতাও নিতে হয়েছে।
এখন স্থায়ী কোনো ঠিকানাহীন আবুলের বাবা মৃত কলিম উদ্দীন একজন দিনমজুর ছিলেন। তাদের বাড়ি ছিল ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সোহাগী গ্রামে। ১২ বছর আগে বাবার মৃত্যুর পর মা তাকে নিয়ে মিঠামইনে চলে আসেন। এরপর থেকে অভাবের তাড়নায় ছেলেকে সঙ্গে করে আবুলের মা হাজেরা খাতুন ভিক্ষাবৃত্তিতে নামেন।
ভিক্ষুক মা হাজেরা খাতুনের সন্তান আবুলের অনন্য মেধার সাক্ষর দেখে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সমাজের বিত্তবান মানুষেরা আর্থিক সহযোগিতাও করেছেন।
বর্তমানে মিঠামইন উপজেলা প্রকৌশলীর বাসায় অবস্থান করছে আবুল।
তার মা হাজেরা খাতুন বাংলানিউজকে বলেন, ভিক্ষা করে ছেলের জন্য খাবার জুগিয়েছি। আমার স্বামী মারা যাওয়ায় পর শিশু ছেলেকে নিয়ে ভিক্ষা করেছি। মিঠামইনে শিক্ষক শ্যামল মাস্টার প্রথমে ইসলামপুর সরকারি বিদ্যালয়ে আবুলকে ভর্তি করেন। প্রতিদিন ভিক্ষা করে খাবার জোগার করে স্কুলে নিয়ে যেতাম। রাত্রি যাপন করেছি সরকারি অফিসের বারান্দায়। রাস্তার বিদ্যুতের আলোতে আমার ছেলে পড়াশোনা করেছে।
তার মায়ের ইচ্ছা ছেলেকে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বানাবেন। তিনি আরো জানান, কলেজে ভর্তির জন্য ভিক্ষা করে কিছু টাকা জমিয়েছেন। ছেলের জন্য সমাজের বিত্তবানদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি।
আবুল জানায়, তাদের সঙ্গতি মিঠামইনবাসী সবাই জানে। কলেজের অধ্যক্ষ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সবাই তাদের সাহায্য করেছেন।
আবুলের স্বপ্ন উচ্চশিক্ষা লাভ করে বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসনের বড় কর্মকর্তা হবে সে। কিন্তু তার স্বপ্নের অন্তরায় রয়েছে আর্থিক সঙ্গতির অভাব। তার স্বপ্ন পূরণে সমাজের বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতা কামনা করে সে।
সমাজের দুঃস্থ ও আর্তপীড়িত মানুষের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে বাংলানিউজের নিজস্ব ত্বত্তাবধানে পরিচালিত হচ্ছে 'বাংলানিউজ সোশ্যাল সাভির্স' (বিএনএসএস) সামাজিক সেবা কর্মসূচি।
আবুলকে বাংলানিউজের মাধ্যমে সাহায্য করতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন, বিএনএসএস এর আহ্বায়ক শারমীনা ইসলাম, ফোন: ০১৯৩৭১৯৯৩৭৬ বা ইমেল: help.bnss24@gmail.com এর মাধ্যমে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১০ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৪