খুলনা: আগামী একশো বছরের একাডেমিক ও অবকাঠামোগত চাহিদা মাথায় রেখে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি) ক্যাম্পাস সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য বর্তমান ১০৬ একর জমির সঙ্গে ক্যাম্পাস সংলগ্ন ২০৩ একর খালি/পতিত জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির সম্প্রসারিত এই নতুন ক্যাম্পাস করা হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। নাম হবে—খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু ক্যাম্পাস।
জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে খুলনা জেলা প্রসাশকের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া গণপূর্ত ও গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং একই মন্ত্রণালয়ের সচিবকেও এ ব্যাপারে অবগতির জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত এলাকায় কোনো বাড়িঘর নির্মাণের পরিকল্পনা অনুমোদন না দেওয়া বা ওই জমিতে কেডিএ কর্তৃক কোনো পরিকল্পনা না নিতে অনুরোধ জানিয়ে ওই কর্তৃপক্ষের চেয়ারমানের কাছেও বেশ কয়েকবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চিঠি দিয়েছে।
জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এসব উদ্যোগের বিষয় বুধবার (১১ নভেম্বর) দুপুরে খুবির জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক এস এম আতিয়ার রহমান নিশ্চিত করেছেন।
নতুন এই ক্যাম্পাসে আগামী দিনের চাহিদার আলোকে যুগোপযোগী শিক্ষা, গবেষণাসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন বিষয় খোলার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। সামুদ্রিক সম্পদ বিকাশ, আহরণ, সংরক্ষণের মাধ্যমে সুনীল অর্থনীতির বিকাশ, জলবায়ু ও উপকূলীয় পরিবেশ ও প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, সুন্দরবন নিয়ে অধিকতর গবেষণা, মহাকাশ বিজ্ঞানসহ নতুন নতুন কারিগরি ও প্রযুক্তিগত বিষয়, সামাজিক ও মানবিক বিদ্যার নতুন নতুন শাখায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার ওপর আগামী দিনে জোর দেওয়া হবে।
ক্যাম্পাস সম্প্রসারণের যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলা হচ্ছে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বধ্যভূমির ওপর। ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠালগ্নে বাংলাদেশ বেতারের পরিত্যক্ত ১০৩ একর জমির ওপর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ১৯৯০-৯১ সালে শিক্ষা কার্যক্রমের শুরুতে ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) সংখ্যা ছিলো ৪টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো ৮০ জন। বর্তমানে ডিসিপ্লিনের সংখ্যা ২৯টি এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার।
এছাড়াও রয়েছে ২টি ইনস্টিটিউট, ২টি সেন্টার ও একাধিক সহশিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নতুন করে তেমন কোনো জমি অধিগ্রহণ হয়নি। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমেরও ৩০ বছর পার হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ওই জমির ওপর ৩টি একাডেমিক ভবন, ৫টি আবাসিক হল, একটি সুপরিসর লাইব্রেরি ভবন, একটি গবেষণাগার, ফিটনেস সেন্টার, ২টি মসজিদ, ১টি মন্দির, ২টি প্রশাসনিক ভবন, একটি গেস্ট হাউজ, ৬টি আবাসিক কোয়ার্টার, একটি খেলার মাঠসহ অন্তত ৭টি ডিসিপ্লিনের প্রয়োজনের তুলনায় খুব ছোট ছোট মাঠ-গবেষণাগার তৈরি করা হয়েছে। অথচ এসব ডিসিপ্লিনের মাঠ-গবেষণার জন্য আরও জমি প্রয়োজন।
চলতি উন্নয়ন পরিকল্পনায় আরও একটি দশতলা একাডেমিক ভবন (জয়বাংলা ভবন), লালন সাঁই মিলনায়তন (টিএসসি) সুলতানা কামাল জিমনেসিয়াম ভবন, শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরী মেডিকেল সেন্টারসহ বেশ কয়েকটি বড় ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চলতি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এসব ভবনের কাজ আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে শেষ হলে ক্যাম্পাসে আর কোনো খালি জায়গা থাকবে না।
এমন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আগামী একশো বছরে চিন্তা করে কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাস সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস সংলগ্ন আর মাত্র ২০৩ একর জায়গা রয়েছে, যেখানে কোনো কৃষি ফসল হচ্ছে না। এখানে জমির প্লট করে বা ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু ঘরবাড়ি নির্মাণ হয়েছে, যা এখনও সংখ্যায় সীমিত। এসব বাড়ি-ঘর নির্মাণে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করেনি। ফলে তা অনুমোদন বর্হিভূত।
দেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নে বর্তমান সরকারের রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের অভিলক্ষ্য অর্জনের সাথে সঙ্গতি রেখে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ক্যাম্পাস সন্নিহিত উত্তর-পশ্চিম-পূর্ব এলাকার ২০৩.০৩ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য গত ০৪ ফেব্রুয়ারি খুলনা জেলা প্রশাসক বরাবর একটি চিঠি দেওয়া হয় বলে জানা যায়। ওই জমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকেই বিদ্যমান সড়ক-মহাসড়ক হবে (দক্ষিণে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক, পশ্চিমে রূপসা বাইপাস সড়ক, উত্তরে সোনাডাঙ্গা বাই পাস সড়ক এবং পূর্বে গল্লামারী লিনিয়ার পার্ক ওয়াপদা সড়ক) বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা। ফলে বিদ্যমান ও ভবিষ্যৎ প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিকল্পিত সম্প্রসারণ সম্ভব হবে।
অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবিত এলাকাটিকে ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু ক্যাম্পাস হিসেবে নামকরণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে। বিদ্যমান এবং ভবিষ্যতের প্রয়োজনের নিরিখে দেশের তথা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা সম্প্রসারণে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ওই ২০৩.০৩ একর জমিতে বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারিত হলে তা অনাগতকাল ধরে শিক্ষা ও গবেষণার দীপ্তি ছড়াবে, যার আলোয় আলোকিত হবে এ দেশের আপামর মানুষের অগণিত সন্তান। আর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি অর্জনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরন্তর প্রচেষ্টায়।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে কোনো বদ্ধ জলাশয় হিসেবে চিন্তা করলে চলবে না। যুগের চাহিদা অনুযায়ী জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে নিরন্তর গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। একই সাথে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে এবং সকল ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দিকনির্দেনা পাওয়া যায়। তাই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সে দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যত সমৃদ্ধির প্রধান অন্তরায় হবে জায়গার অভাব। এই এলাকাটি নরম মাটির হওয়ার পরও আমরা বহুতল ভবন নির্মাণের দিকে এগোচ্ছি। কিন্তু তারপরও আগামী পাঁচ-দশ বছর পর জায়গা সংকট তীব্র হয়ে দেখা দেবে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যদি আগামী পঞ্চাশ বা একশো বছরের ভবিষ্যত চিন্তা বা পরিকল্পনার কথা ভাবা হয় তা হলে বর্তমান ক্যাম্পাস সংলগ্ন ২০৩ একর জমি অধিগ্রহণ খুবই জরুরি। তা না হলে এসব জায়গায় অসংখ্য ঘরবাড়ি নির্মিত হলে ভবিষ্যতে নানাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই আমরা সার্বিক বিষয় চিন্তা করে সংলগ্ন ২০৩ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করেছি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস আমরা বঙ্গবন্ধুর নামে করতে চাই, এ কারণে যে দেশের অন্যতম মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমিতে গড়ে ওঠা একমাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয় যতদিন থাকবে বঙ্গবন্ধুর নাম ও স্মৃতি অম্লান হয়ে থাকবে। শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ আপামর মানুষ অনুপ্রাণিত হবে। একই সাথে দেশের সাধারণ মানুষের অসংখ্য সন্তান এখান থেকে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ লাভ করে দেশ মাতৃকার সেবায় নিয়োজিত হতে পারবে, যা ছিল জাতির পিতার স্বপ্ন।
এ ব্যাপারে বৃহত্তর উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মহাসচিব শেখ আশরাফ-উজ জামান বলেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ক্যাম্পাস সম্প্রসারণের উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই এবং এটি একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০২০
এমআরএম/এমজেএফ