ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নির্বাচন

নেত্রকোনা থেকে মাহবুব আলম

‘নির্বাচন অইতাছে কাউন্সিলররার’

মাহবুব আলম ও সৌমিন খেলন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৫
‘নির্বাচন অইতাছে কাউন্সিলররার’ ছবি : শাকিল/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নেত্রকোনা পৌর এলাকা ঘুরে: শীতের সকালে কুয়াশা তখনও ঘিরে রেখেছে চারপাশ। শহরের অলি-গলিতে কিংবা রেলস্টেশনে নিম্ন আয়ের মানুষজন আগুন পোহায়ে পৌষি শীতের কামড় থেকে রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন!
 
কেউ ছুটছেন নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, কেউ বা আপন কাজে।

শীতের সকালের ‘ওম’ ছেড়ে ওঠা শিশুটিও ঘুম ঘুম চোখে ব্যাগ নিয়ে চলছে কিন্ডারগার্টেন বা স্কুলের দিকে।
 
সমান তালে আসন্ন পৌর নিবার্চনে অংশ নেওয়া প্রার্থীরাও ছুটেছেন ভোটারদের দুয়ারে-দুয়ারে।
 
দেশের ২৩৪ পৌরসভার মতো ভোটের হাওয়ায় সরগরম আধ্যাত্মিক সাধক শাহ সুলতান কমর উদ্দিনের পীঠস্থান নেত্রকোনা পৌর এলাকাও।

সাধারণ ভোটাররা বলছেন, মেয়র নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ায় দুই প্রধান রাজনৈতিক দল থেকে নৌকা-ধানের শীষে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওয়ার্ডগুলোতে কাউন্সিলর পদে রয়েছেন অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই কাউন্সিলর প্রার্থীদের তৎপরতাই বেশি।

দেশের উত্তরাংশে মগড়া নদীর দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে ছিমছাম ছোট্ট শহর নেত্রকোনা। জেলার অন্য চার পৌরসভা থেকে জেলা শহরের বাসিন্দারা কিছুটা বেশি নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। তবে তা খুবই অপ্রতুল।
 
শহরের ফৌজদারি ব্রিজ থেকে এগিয়ে মোক্তারপাড়ায় একটি চায়ের স্টলে কথা হয় কৃষি উদ্যোক্তা লিটু সেনের সঙ্গে।
 
শহরের অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি নির্বাচনে ভোটের ঝড় নিয়েও কথা বলছিলেন তিনি।

বাংলানিউজকে সচেতন ভোটার লিটু বলেন, ‘মেয়র নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মধ্যে তেমন আগ্রহ নেই। তবে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যেই নির্বাচন চলছে। নিজ নিজ ওয়ার্ডে তারাই বেশি প্রচার-প্রচারণা ও তৎপরতা চালাচ্ছেন। তারা যখন একসঙ্গে প্রচারণায় বের হন, তখন একটা সাজ সাজ রব বিরাজ করে।
 
লিটুর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন এগিয়ে এলেন তার প্রতিবেশী হাফেজ মো. জাহাঙ্গীর আলম।
 
তিনি বলেন, ‘দলীয়ভাবে নির্বাচন হওয়ায় কোনো বাড়তি প্রার্থী নেই। নৌকা-ধানের শীষের দু’জনই প্রচারণা চালাচ্ছেন। কিন্তু এখানে আওয়ামী লীগই এগিয়ে আছে’।

এর মধ্যেই রেজাউলের চায়ের দোকানে এলেন মো. শুক্কুর আলী, যিনি নারকেল গাছ পরিষ্কার করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
 
নির্বাচনী হাওয়া কেমন বইছে? প্রশ্নটা শুনেই যেন ভড়কে গেলেন তিনি। বললেন, ‘আমরা কিতা কইতাম। হারাদিন কাম (কাজ) করি আর ভাত খাই। ভুটে তো যাইয়ামই’।    

তবে এমন কথায় সায় দেওয়ার পাত্র নন রিকশাচালক চালশে তোতা মিয়া, যিনি শহরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে থাকেন।
 
দোকানিকে চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা পাউরুটি নিয়ে বসে পড়লেন পাশের বেঞ্চে।
 
পাউরুটি খেতে খেতে গল্পে শরিক হন, ‘ভাই নির্বাচন তো কমিশনাররার (কাউন্সিলর) মধ্যে, মেয়র নিয়া এতো কথা কেরে?’
 
কারণও নিজ থেকে বাতলিয়ে বললেন, ‘নৌকা আর ধান অইলো আবেগের মার্কা। এর কোনো ওর্য়াক (প্রচার-প্রচারণা) লাগে না। তবে আমরার এইনো নৌকাই যাইবো’।

এবার নেত্রকোনা পৌরসভার নির্বাচনে তিনজন মেয়র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন দলটির জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম খান। আর ধানের শীষে নির্বাচন করছেন জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম মুনিরুজ্জামান দুদু। তবে কোদাল প্রতীকের প্রার্থী বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সজীব সরকার রতনের কোনো প্রচারণা নেই। শহরজুড়ে দেখা মেলেনি তার কোনো পোস্টারও।  

সদরের ভোট নিয়ে বেশ হিসেব-নিকেশ করছেন ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবুল হোসেন। বললেন, ‘মগড়ার পশ্চিম পাড়ে অর্থাৎ ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে অনেক ভোটার রয়েছেন। তারা যাকে সাপোর্ট করবেন, মেয়র হবেন তিনিই। সেক্ষেত্রে নজরুল ও দুদুর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে’।
 
পৌরসভার পাশে জেলা গ্রন্থাগারের সামনের চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে একই কথা বললেন উত্তর সাতপাইয়ের ভোটার ফখরুল হাসান ও রফিকুল ইসলাম এবং নিউটাউনের তানজিনা আকতারও।  
 
২১ দশমিক ২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ‘ক’ শ্রেণির এ পৌরসভায় এক লাখ ২ হাজার মানুষ বাস করেন।

এসব মানুষের রয়েছে নানা সমস্যা। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, ড্রেনেজ ব্যবস্থার অভাবসহ আরও কতো কী? এমনকি খোদ পৌর ভবনের সামনের সড়কের খোলা জায়গায়ও আবর্জনা ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।

স্থানীয়রা জানালেন, বর্তমানে নেত্রকোনার বড় সমস্যা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচলে সৃষ্ট যানজট।
 
অত্যাধিক অটোরিকশার অপরিকল্পিত চলাচল আর যাত্রী ওঠা-নামার কারণে শহরজুড়ে দিনভর এ যানজট লেগে থাকে। প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনাও।
 
একটু এগিয়ে গেলে ছোটবাজারে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় কথা হয় রুকন মিয়ার সঙ্গে। কলেজে ক্লাস করতে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু কুরপাড় থেকে দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের কিছু পর এসেই যানজটে আটকে আছেন নেত্রকোনা সরকারি কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের এই ছাত্র।
 
বললেন, ‘এই অটোওয়ালারা যেদিকে সুযোগ পান, সেদিকেই ঢুকিয়ে দেন। আর এভাবে পুরোটা সড়ক জুড়ে যানজট লেগে থাকে’।
 
‌‘ঘটে দুর্ঘটনাও। তবে এ বিষয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই’- বেশ ক্ষোভ নিয়ে বললেন নতুন এ ভোটার।

তার মতো একই প্রতিক্রিয়া সবুর মিয়া, আবদুল বারেকেরও। তারা বলেন, ‘এবার যারা মেয়র হবেন, তাদের এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিৎ। আমরাও তাকেই ভোট দেবো’।  

৯ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার তারা মিয়া বলেন, ‘মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে এগিয়ে আছেন নজরুল-দুদুই। কোদাল মার্কা রতনের কোনো খবর নাই’।
 
স্থানীয় সূত্র জানায়, নেত্রকোনা আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন সময় ‌‘দ্বন্দ্বে’ বিভক্ত ছিলেন।
 
তবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলা কমিটির মধ্যে ‘ঐক্যবদ্ধ’ হয়েছেন তারা। এমনকি এক হয়ে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাচ্ছেন নেতারা।
 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, জেলায় যে গ্রুপিং ‘ছিল’ তা নির্বাচনে প্রভাব পড়বে না।
 
ছোটবাজারে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পোস্টার-লিফলেট নিয়ে ভোটারদের কাছে প্রচারণা চালাতে বের হচ্ছেন।

তবে ছোটবাজারের বিএনপি কার্যালয়ে গিয়ে তেমন কাউকে দেখা যায়নি। কিন্তু মেয়র প্রার্থী এসএম মনিরুজ্জামান দুদু তার কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন।  

পৌর এলাকার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার তারা মিয়া ও হামিদুর রহমান বলেন, ‘ভুট দেওন লাগে দিয়াম, আমরা আওয়ামী লীগ বিএনপি বুঝি না, যে উপযুক্ত তারেই নির্বাচিত করবাম’।
 
নেত্রকোনা পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে ৫৮ হাজার ৪১৪ জন ভোটার রয়েছেন। এবার ৯টি সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৪৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। আর তিনটি সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে লড়ছেন ১২ নারী প্রার্থী।
 
শহরের ২৫টি কেন্দ্রে ৩০ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন ভোটাররা।
 
বাংলাদে সময়: ১২৪৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৫
এমএ/এএসআর

** সেবা নিশ্চিত করলে ভোট দেবেন ভোটাররা

** প্রচারণায় আ.লীগ-‌‘বিদ্রোহী’, নিশ্চুপ বিএনপি
** ‘খালি কী ভুট দিলেই অইবো, প্রার্থীরারেও দেহন লাগবো’
** মগড়ার এপার-ওপার দ্বন্দ্বে ‌‘বঞ্চিত’ পৌরবাসী
** ‘নির্বাচনে চা বেচা তো বাড়ছে না’
** ভেদাভেদ ভুলে সমান তালে নৌকা-ধানের শীষ
** ত্রিমুখী লড়াইয়ে সরগরম ভোটের মাঠ
** আ’লীগ-বিএনপি নয়, লড়াই ‘ইছা-পচার’
** ‘হারা বছর হবর নাই, এবার বুইজ্জা হুইন্না ভুট দিয়াম’
**  ডিজিটাল নির্বাচনী প্রচারণায় প্রার্থীরা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।