কিন্তু গানের চেয়ে ভিডিওর মূল্য কি বেশি? আর ভিডিওতে গানের কথার সঙ্গে গল্পের কতটুকু সামঞ্জস্যতা আছে? গানেই বা কথা নির্ভরতা কোথায়? অথচ বাংলা গানের মূলশক্তি কিন্তু কথায়। কথায় প্রাণ নেই, সুরে ঘ্রাণ নেই তবুও গান হচ্ছে।
এই আক্ষেপগুলো অবশই যুক্তিসঙ্গত। এ প্রজন্মের অধিকাংশ শিল্পীরা ভালো কথার গানের পেছনে ছুটছেন না। ছুটছেন হিট গানের পেছনে। হিট গান চাই, হিট। এই হিটের প্রত্যাশাই ভালো গানের ধারাকে ধূলিসাৎ করছে।
এ প্রসঙ্গে দেশবরেণ্য গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, একজন ভালো কবি কখনও চাইলেই যা-তা গান লিখে দেবেন না। আর যখন লিখে দেবেন না তখন তারা যাকে-তাকে দিয়ে লেখাবে। অবশ্য এখন এই ধারাটাই চলছে। গান লেখার তো একটা নিয়ম আছে, তাই না? সেটা ক’জন জেনে লিখছে। এ রকম অনেক প্রশ্নই আছে। কিন্তু লাভ কি! না জেনে কিছু করলে যা হওয়ার তা-ই এখন হচ্ছে।
গানে ভিডিওর প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে তিনি বলেন, নিকৃষ্ট মানের ভিডিও হচ্ছে। এগুলো দেখা যায় না। কথাতে বার্তা নেই, সুর-সঙ্গীতে আবেদন নেই অর্থাৎ কথায় কি শুনছি আর ভিডিওতে কি দেখছি- কিছুই বুঝতে পারি না। খুবই হতাশজনক। তবে হ্যাঁ, এটাও বিশ্বাস করি- প্রত্যেকটা সমস্যারই সমাধান আছে। এ অবস্থা থেকেও উত্তরণের উপায় আছে, তা হচ্ছে- সঙ্গীত সংশ্লিষ্টদের সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। সংঘদ্ধ হয়ে ভালো কিছু সিদ্ধান্ত নিলেই ভালো গান পাওয়া সম্ভব।
এদিকে, বর্তমান গান বাজারের অবস্থা সম্পর্কে গঠনমূলক বক্তব্য দিয়েছেন শ্রোতাপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী-দর্শকপ্রিয় অভিনেতা তাহসান।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমার সঙ্গীত ক্যারিয়ারের ১৭-১৮ বছর হয়ে গেলো। এ সময়টা শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সঙ্গীতের ভালো-মন্দ দু’টো দিকই আমি দেখে আসছি। অর্থাৎ ভালো-মন্দ সব সময় ছিলো। কিন্তু দিনশেষে ভালোটাই মানুষ গ্রহণ করে এবং সেটাই থেকে যায়। তবে হ্যাঁ, এখন অনেকে গানের চেয়ে ভিডিওর দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এটা অযৌক্তিক। সবার আগে অডিওকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ গান থেকে ভিডিও, ভিডিও থেকে গান নয়। আর ভিডিওর ক্ষেত্রেও যত্নবান হওয়া উচিত। কেননা, গানের সঙ্গে গল্পের মিল না থাকলে কিংবা নকল ভিডিও হলে সেটা প্রশংসা পাওয়ার চেয়ে সমালোচিতই হয় বেশি। কারণ, ভালো-মন্দের মানদণ্ডটা দর্শক-শ্রোতার হাতেই থাকে। আর ভালো গান শ্রোতারা গ্রহণ করবেই। যেমন, আমার ‘প্রেম তুমি’ লিরিক্যাল ভিডিও গানটি প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই শ্রোতামহলে বেশ প্রশংসিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে চিরকুট ব্যান্ডের প্রধান ভোকাল শারমিন সুলতানা সুমি বলেন, আমি আসলে সব সময় ইতিবাচক চিন্তার মানুষ। আমি একজন ব্যান্ডশিল্পী হিসেবে বলবো- ব্যান্ডের গান সব সময় ভালো ছিলো, এখনও ভালো হচ্ছে। অবশ্য ব্যান্ডের বাইরেও অনেক ভালো গান হচ্ছে। কিন্তু প্রচারণার অভাবে গানগুলো শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভালো গান শোনার মানসিকতাও তৈরি করতে হবে। তাহলেই সবাই মানসম্মত গানে মনোনিবেশ করবেন।
বতর্মান সময়ে গানের চালচিত্র প্রসঙ্গে সঙ্গীতশিল্পী অটমনাল মুন বাংলানিউজকে বলেন, ‘গর্ব করেই বলতে পারি- গানের ভালো একজন ছাত্র আমি। গানকে সবার আগে ভেতরে লালন করতে হবে। তার আগে গান শিখতে হবে, জানতে এবং গান নিয়ে সাধনা করতে হবে। গানের প্রাথমিক শর্ত আমার মনে হয় এগুলোই। আর এগুলো না জেনে শুধু হিট কিংবা পরিচিতির জন্য গান করলে যা হওয়ার, তাই হচ্ছে। আর এখনকার সঙ্গীতের যে অস্থিরতা চলছে তার জন্য শুধু শিল্পীরাই দায়ী না, কিছু কিছু সঙ্গীত কারিগরেরাও এর জন্য দায়ী। এর বেশি কিছু বলতে চাচ্ছি না। তবে ভালো সময়ের প্রতীক্ষায় গান করে যাচ্ছি।
দেশ বরেণ্য গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জানের শেষ কথাটাই বার বার কানে বেজে উঠছে। তিনি একাধিকবার একটি কথাই বলেছেন, ‘যখন থেকে কানের বিষয়টা চোখে চলে গেছে, তখন থেকেই সঙ্গীতশিল্পটা তার প্রাণ হারিয়েছে। ’ তার এ কথার সঙ্গে অবশ্য অনেকই একমত হবেন। একমত হবেন ঠিক কিন্তু সময়ের দাবির কাছে নত শিরে পরাস্থ হয়ে গানে ভিডিওর প্রাসঙ্গিকতাকে মেনে নেবেন, নিচ্ছেন। তা হোক, তবে প্রাণবন্ত সুর আর কথানির্ভর গানে ভরে উঠুক আমাদের সঙ্গীতশিল্প। আবার ফিরি আসুক বাংলা গানের ঘোলোআনা সোনালী সময়।
বাংলাদেশ সময়: ১২০৫ ঘন্টা, ১০ নভেম্বর ২০১৮
ওএফবি/আরআর