২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি যাত্রা শুরু হয় ব্যান্ডদল ‘কুঁড়েঘর’র। শুরুতে কভার গান দিয়ে সংগীত অনুরাগীদের নজর কাড়ে একদল তরুণের এই ব্যান্ড।
সবগুলো গানই শ্রোতাদের মন জয় করে। বিশেষ করে ‘পোষা পাখি’ ও ‘বেহায়া মন’ শীর্ষক গান দুটি ভাইরাল হয়। দেশব্যাপী পরিচিত পায় ‘কুঁড়েঘর’। পরিকল্পনা সফল ব্যান্ড সদস্যদের।
হ্যাঁ, ব্যান্ডটির ভোকাল তাসরিফ খান তাই বললেন বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে। তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল কভার গানের মাধ্যমে নিজেদের ব্যান্ডটির পরিচিতি। সেটি প্রথম বছরই হয়, অনেকটা ষোলোকলা পূর্ণ হওয়ার মতোই। এরপর পরিকল্পনা মতো আমরা মৌলিক গানে মনোনিবেশ করি। এখন পর্যন্ত আমরা ৩৮টি মৌলিক গান প্রকাশ করেছি। এর মধ্যে আমাদের অধিকাংশ গানই শ্রোতারা বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন। আমরা খুশি। শ্রোতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা আমাদের পাশে থেকে সমর্থন দেওয়ার জন্য। ’
কুঁড়েঘর’র প্রকাশিত মৌলিক গানের সংখ্যা ৩৮। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘ব্যাচেলর (২০১৭)’, ‘ময়না রে (২০১৭)’, ‘হোমিওপ্যাথিক ডোজ (২০১৮)’, ‘কেউ নেই (২০১৯)’, ‘ভালোবাসি মা (২০২০)’, ও ‘বঙ্গবন্ধু (২০২০)’।
২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর- চার বছরের পথচলা’য় কুঁড়েঘরের অর্জন অনেক। এর মধ্যে তিনবার ভারতসহ দেশব্যাপী ১২০- এর অধিক কনসার্টে অংশ নিয়েছে ব্যান্ডটি। সামনেও রয়েছে দেশের বাইরে কনসার্ট। দেশের বাইরেও তৈরি হয়েছে ব্যান্ডটি ব্যাপক ভক্ত-অনুরাগী, যা ব্যান্ডটির সদস্যদের উৎসাহ-প্রেরণা যোগাচ্ছে উজ্জ্বল আগামীর জন্য। আবেগঘন কণ্ঠে বললেন, ব্যান্ডটির ভোকাল তাসরিফ খান।
এদিকে, সবশেষ সোমবার (২১ সেপ্টেম্বর) নিজেদের চ্যানেলের মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবারের স্বীকৃতিস্বরূপ হাতে পেয়েছেন ইউটিউবের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্বীকৃতি গোল্ডেন প্লে-বাটন। এ প্রসঙ্গে তাসরিফ বলেন, ‘পেছনে ফিরে তাকালে ছবির মতো সব চোখের সামনে ভাসতে থাকে আমাদের শুরুর সংগ্রাম ও পাগলামী। এ যেন অনেকটা শূন্য থেকে সামান্য কিছু হওয়ার গল্প।
‘২০১৬ সালের ৮ আগস্ট নিজের ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেল ক্রিয়েট করেছিলাম। সেদিন ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টের চেনা-অচেনা প্রায় ১৬০০ মানুষকে অনুরোধ করলে ২৪ জন মানুষ চ্যানেলটা সাবস্ক্রাইব করেছিল। আমি তো সেই খুশি! সেদিন থেকেই একা একা গান গেয়ে আপলোড করা শুরু করি আর স্বপ্ন দেখতে থাকি, একদিন আমারও একটা ব্যান্ড হবে, মানুষ আমার গান শুনবে, স্টেজে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে গান গাইবো, আরও কতো কি…! চ্যানেল দাঁড় করানোর পর এলাকার পরিচিত কিছু ছোট ভাই আর বন্ধুকে ডেকে সিদ্ধান্ত নিই, আমরা একটা ব্যান্ড করবো যার নাম ঠিক হয় ‘কুঁড়েঘর’। ’
ব্যান্ড গঠনের শুরুর সংগ্রাম প্রসঙ্গে তাসরিফ বলেন, ‘কলেজের দেয়ালের পাশে কিংবা পুকুর পাড়ে বসে গান করা কয়েকজন উটকো ছেলের (সমাজের অনেকের চোখেই) প্রথম কনটেন্ট ইউটিউবে আপলোড হয় ২০১৬ সালের ৩ ডিসেম্বর। ইউটিউবে কীভাবে আপলোড করতে হয়, এটা ছাড়া আর কোনো জ্ঞান না থাকা আমরা প্রথম দিন শেষে দেখি গান এর ভিউ ৪০০! এ তো মহা অবাক করা ব্যাপার! ৪০০ মানে তো অনেক, পুরো একটা কলেজ মাঠই তো ভরে যায় ৪০০ মানুষ হলে! এতো মানুষ আমাদের গান দেখলো! এর পর দিন আরও, তারপর আরও…! কমেন্ট বক্সে মানুষের প্রশংসায় ভেসে যেতে থাকলাম আমরা।
‘কিছুদিন পরই পুরো ব্যান্ড ঢাকায় চলে আসি এবং আমার (তাসরিফ খান) বাসায় থেকেই আমি, শুভ, সাব্বির, শ্রাবণসহ আরও কয়েকজন মিলে শুরু করলাম কাজ! আমার ছোট ভাই তানজীব খান (বর্তমানে ব্যান্ড’র ফাউন্ডার, গিটারিস্ট এবং ডিজিটাল এক্সপার্ট) বসে বসে শেখা শুরু করলো ইউটিউব আর ভিডিও এডিটিং রিলেটেড পড়াশোনা! আমাদের ব্যান্ড’র রুটিন ছিল সারাদিন ছাঁদে বসে কনটেন্ট তৈরি, এডিটিং, আর রাতের মধ্যেই ইউটিউবে আপলোড। কী যে আবেগের ছিল সে দিনগুলো!
প্রথম কনসার্ট সম্পর্কে কুঁড়েঘর’র ভোকাল বলেন, ‘প্রথম কনসার্টের ফোন পেয়ে কী যে খুশি হয়েছিলাম, বলে বোঝানো যাবে না! দেখতে দেখতে এখন তো ১২০-এর বেশি হয়ে গেছে। প্রথমবার দেশের বাইরে যাওয়া, তারা হুড়োয় পাসপোর্ট করাও একটা বিশাল যুদ্ধ। পাসপোর্টের জটিলতায় তো প্রথমবার ভারতের কনসার্টের তারিখই পেছাতে হয়েছিল। আমাদের একেকটা যুদ্ধ একেকটা বই এর প্রথম অধ্যায়ের মতো, সত্যিই…!
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘যখন আমাদের কনসার্ট ওভাবে শুরু হয়নি কিন্তু ইউটিউবে প্রচুর সাড়া পাচ্ছি, তখন থেকেই আমাদের ব্যান্ডের প্রতিটি মিটিংয়ে বারবারই একটা বিষয় আসতো- সরাসরি কীভাবে মানুষের আরও কাছে যাওয়া যায়? কীভাবে কনসার্টের’র কল ছাড়াও কনসার্ট করা যায়!
‘সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা নতুন একটা কাজ কররো, একটা ভিন্নধর্মী ইভেন্ট! নাম হবে ‘কুঁড়েঘর আড্ডা’। ব্যাপারটা তেমন কিছুই নয়, ফেসবুকে ইভেন্ট/স্ট্যাটাস কিংবা ফোনে যোগাযোগ করে কোনো একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে অপরিচিত মানুষের সঙ্গে আড্ডা আর গান গাইবো। বিশ্বাস করার মতো না, কতো যে অসাধারণ ছিল ব্যাপারগুলো। আমরা ধানমন্ডি লেক, রবীন্দ্র সরোবর, সংসদ ভবনের’র সামনে কিংবা কোনো একটা জেলার মাঠে চলে গেছি পুরো ব্যান্ড এবং শুরু করেছি আড্ডা। অনেকেই শুরুতে হেসেছে, কিন্তু দিন শেষে যখন ঘরে ফিরেছি, ভালো লাগা আর মানুষ সম্পর্কে শেখার খাতাটা আরও পূর্ণ হয়েছে।
তাসরিফ বলেন, ‘আমাদের যেমন শেখার গল্প ছিল তেমনি মন ভাঙার গল্পও ছিল। ব্যান্ডের শুরুতে যখন আমরা ঢাকায় আসি, আমার ভার্সিটির এক বন্ধুর মাধ্যমে একটা পারফর্মেন্সের ডাক পাই ধানমন্ডির এক নামিদামি রেস্টুরেন্টে। আমরা তো সেদিন অনেক এক্সাইটেড! টুকটাক শপিংও করি, কনসার্ট বলে কথা। সারাদিন গানগুলো বারবার প্র্যাকটিস করে সন্ধ্যায় পারফর্ম করবো বলে। ২ ঘণ্টা বসে থাকি আমাদের ডাক আসলে আমরা স্টেজে উঠবো। হঠাৎ একজনে আয়োজক এসে জনায় যে, তাদের হাতে তেমন সময় নেই, আমাদের পারফর্মেন্সটা হবে না। আমরা কিছুক্ষণ নিজেদের মুখ চাওয়া করে চুপচাপ ধানমন্ডি লেকে চলে যাই। রাতের অন্ধকারে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম আমি, শুভ আর শ্রাবণ। আমি তাদের চোখের দিকে তাকাবার সাহস পাইনি সেদিন রাতে।
ব্যান্ডের নতুন কাজ সম্পর্কে তাসরিফ বলেন, ‘নতুন কিছু কাজের পরিকল্পনা করছি। শিগগিরই শুরু করবো। ধারাবাহিকভাবেই বেশ কয়েকটি মৌলিক গান তৈরি করবো। তবে, কিছুটা সময় নিয়েই এবার গান তৈরি করতে চাই। সামনে ভালো কিছুই উপহার দিতে চাই বাংলা গানের শ্রোতা তথা কুঁড়েঘর’র ভক্ত-অনুরাগীদের।
অনেক কথার ভিড়ে তাসরিফের কথায় নিশ্চিত হওয়া গেলো যে, ‘স্বল্প দিনের সংগীত সংগ্রামে তারা সফল। ‘কুঁড়েঘর’ দেশব্যাপী ব্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। দেশের বাইরে থেকে আসছে শো’র প্রস্তাব। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সঙ্গে কাজ আগ্রহ দেখাচ্ছে। শ্রোতারা তাদের গান শুনছেন। নিজেদের চ্যানেলের মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবারের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ইউটিউবের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান গোল্ডেন প্লে-বাটন। সবমিলিয়ে, তাঁদের স্বপ্নের ‘কুঁড়েঘর’ থেকে সংগীতের দ্যুতি ছড়াচ্ছে সর্বত্র।
কুঁড়েঘর’র লাইন-আপ: তাসরিফ খান (ফাউন্ডার, গীতিকবি-কম্পোজার ও ভোকাল), তানজীব খান (লিড গিটার ও ম্যানেজার), কে এম সিদ্দিক (গীতিকবি), ফরিদুল হক মিথু (বেজ), শামস উল আলম (গিটার), ইমরান হোসাইন শান্ত (ড্রামস), ইয়ামিন প্রান্ত (বাঁশি ও বেক ভোকাল), আজিজুল হক (গীতিকবি)।
বাংলাদেশ সময়: ২০০৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২০
ওএফবি