লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছিলেন, বাংলা উপন্যাসের ছোট একটা তালিকা করলেও ‘পথের পাঁচালী’কে বাদ দেওয়া অসম্ভব। দশখানার মধ্যে একখানা তো বটেই, পাঁচখানার মধ্যেও একখানা!
‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’ মূলত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী ও তার পরের উপন্যাস অপরাজিতকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
রোববার (২ মে) সারাবিশ্বে সত্যজিৎ রায় ভক্তরা উদযাপন করছেন তার জন্মশতবার্ষিকী, বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য আজ তাই রইলো তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’র পর্দা ও পেছনের গল্প-
বিশ্ববিখ্যাত নির্মাতা জ্যাঁ রেঁনোয় ১৯৪৯ সালে কলকাতায় যান ‘রিভার’ চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে। সেখানে সত্যজিৎ রায় তাকে চলচ্চিত্রের লোকেশন খুঁজতে সাহায্য করেন। সে সময়ই সত্যজিৎ রায় রেঁনোয়াকে ‘পথের পাঁচালী’র কথা বলেন, তখন রেঁনোয়া তাকে এটি নির্মাণে উৎসাহ দেন। ১৯৫০ সালে লন্ডন সফরে ছয় মাসে ৯৯টি চলচ্চিত্র দেখেন সত্যজিৎ রায়। এরমধ্যে ইতালীয় পরিচালক ভিত্তোরিও ডি সিকারের ‘বাইসাইকেল থিভস’ চলচ্চিত্রটি তাকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করে। প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়েই সত্যজিৎ রায় সিদ্ধান্ত নেন, তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনা করবেন। এরপরই শুরু হয় সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র অভিযান।
কোনো এক চলচ্চিত্রপাঠ অনুষ্ঠানে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রে একটি খলচরিত্র আছে সেটি কে (কি)? অনেক ভাবনার পর উত্তর এলো। ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রের খলচরিত্র অন্য কিছুই না, সেটি হলো দারিদ্র! প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পথের পাঁচালী উপন্যাসটি প্রকাশ করেন ১৯২৯ সালে। চিরায়ত বাংলার গ্রামে দুই ভাইবোন অপু আর দুর্গার বেড়ে ওঠার ঘটনা নিয়ে লেখা উপন্যাসের ছোটদের জন্য সংস্করণটির নাম আম আঁটির ভেঁপু।
১৯৪৩-৪৪ সালের দিকে সত্যজিৎ রায় যখন এক নামকরা প্রকাশনী সংস্থার মালিক ডি কে গুপ্তর অফিসে প্রচ্ছদের কাজ করতেন। সে সংস্থায় কাজ আসে পথের পাঁচালী উপন্যাসের একটি কিশোর সংস্করণ আম আটির ভেঁপু প্রকাশের। সেই বইয়ের তিনি যখন প্রচ্ছদ আঁকতে যান, তখনই তিনি প্রথম উপন্যাসটি পড়েন এবং নিজের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে এটিকেই নির্মাণের জন্য বেছে নেন। ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রের আসলে কোনো চিত্রনাট্য লেখা হয়নি। সত্যজিৎ তার আঁকা ছবি ও টীকাগুলি থেকে এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। তিনি অফিসের কাজে ১৯৫০ সালে লন্ডনের উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রার সময় জাহাজে বসে কালজয়ী চলচ্চিত্রের সমস্ত নোটগুলো লেখেন।
‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রটি বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে নিশ্চিন্তপূর নামক বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে অপু ও তার পরিবারের জীবনকথন। পুরোহিত হরিহর রায় তার স্ত্রী ও দুই সন্তান অপু ও দূর্গাকে নিয়ে নিশ্চিন্তপুরের পৈতৃক ভিটায় বসবাস করেন। পেশায় পুরোহিত হওয়ায় সামান্য আয়ে টেনেটুনে চলে তাদের অভাবের সংসার। হরিহরের স্ত্রী সর্বজয়া তার দুই সন্তান অপু-দুর্গা এবং হরিহরের দূর সম্পর্কের বিধবা পিসি ইন্দির ঠাকরুণের দেখাশোনা করেন। দরিদ্রের সংসারে যেখানে নিজেদেরই দুবেলা খাওয়া অনিশ্চিত সেখানে নিজের সংসারে বৃদ্ধা ইন্দির ঠাকরুনের জুড়ে বসাটাকে অপছন্দের চোখে দেখেন সর্বজয়া। সর্বজয়ার অত্যাচারে ইন্দির তাই মাঝে মাঝে অন্য এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। অভাব যতই থাকুক ভাইবোন অপু ও দুর্গার মধ্যে যেন খুব সখ্যতা।
দুর্গা দিদি হলেও মায়ের মতোই অপুকে ভালবাসেন। দুই ভাই-বোন মিলে কখনো চিনিবাস ময়রার পিছু পিছু ছোটে, কখনো ভ্রাম্যমাণ বায়োস্কোপ-ওয়ালার বায়োস্কোপ দেখে কিংবা যাত্রাপালা দেখে, কখনো চুপচাপ গাছতলায় বসে থাকে। একদিন তারা বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে আসে ট্রেন দেখার জন্য। কাশের বনে ট্রেন দেখার জন্য অপু-দুর্গার ছোটাছুটির দৃশ্যটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম আইকনিক দৃশ্য। কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে তারা দেখে বার্ধক্যে জরাজীর্ণ ইন্দির ঠাকরুন মরে পড়ে আছেন।
গ্রামের উপার্জনের চল ছিল না দেখে হরিহর একটা ভালো কাজের আশায় শহরে যান। বাড়ি ছাড়ার পর অপু-দূর্গাদের অভাব বাড়তেই থাকে। কোনো এক বর্ষাকালে দুর্গা অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধায়, আর সেই জ্বরই তার কাল হয়। ওষুধের অভাবে শেষে এক ঝড়ের রাতে দুর্গা মারা যায়। হরিহর ফিরে এসে দেখে তার প্রিয় কন্যাটি আর বেঁচে নেই। গ্রাম ও পৈতৃক ভিটে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যায় তারা। চলচ্চিত্রটির শেষ দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই, অপু তার বাবা-মায়ের সঙ্গে গরুর গাড়িতে চড়ে অজানা এক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলেছে।
চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় অপুর চরিত্রে অভিনেতা খুঁজতে সত্যজিৎ রায় সেসময় রীতিমতো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন! অনেক যাচাই বাছাই করেও যখন তিনি বছর ছয়েকের অভিনেতা খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখনই তার স্ত্রী বিজয়া রায় ছাদ থেকে পাশের বাড়িতে একটা ছেলেকে দেখতে পান। এই পাশের বাড়ির শ্রীমান সুবীর ব্যানার্জিই বনে যায় ‘পথের পাঁচালী’র অপু।
চলচ্চিত্র মুক্তির আগ থেকেই অপু-দূর্গার বাবার চরিত্রে অভিনয় করা কানু বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা চলচ্চিত্র জগতের একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা ছিলেন। অপু-দূর্গার মা চরিত্রে অভিনয় করা সত্যজিতের বন্ধুপত্নী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের অপেশাদার অভিনেত্রী। দুর্গার ভূমিকায় অভিনয় করা উমা দাশগুপ্ত ‘পথের পাঁচালী’র আগে কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। এছাড়া এক সময়ের মঞ্চ অভিনেত্রী চুনিবালাকে যৌনপল্লী থেকে নিয়ে আসা হয় ইন্দির ঠাকরুন চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে।
তখন ‘পথের পাঁচালী’র প্রি-প্রোডাকশনের কাজ মোটামুটি শেষ। প্রযোজক খুঁজতে গিয়ে মোটামুটি ৭০ হাজার টাকার একটা খসড়া বাজেট তৈরি করা হয়। কলকাতার এক থিয়েটার মালিক শিশির মল্লিকের সূত্র ধরে রানা বাবু নামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি চলচ্চিত্রটির জন্য ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত লগ্নি করতে রাজি হয়ে যান। সে অনুযায়ী শুটিংও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু মাঝপথে হঠাৎই কোনো এক অদৃশ্য কারণে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেন রানা বাবু। অনির্দিষ্টকালের জন্য দৃশ্যধারণের কাজ বন্ধ করে আবার শুরু হয় প্রযোজক খোঁজার কাজ। কোনো ফলাফল হচ্ছিল না দেখে চলচ্চিত্রের কাজ শেষ করতে বন্ধুদের কাছ থেকে ধার, পছন্দের বই ও সংগীতের অ্যালবাম বিক্রি, স্ত্রীর গহনা বিক্রি থেকে শুরু করে কী করেননি সত্যজিৎ!
শেষমেশ চলচ্চিত্রের কাজ শেষ করার জন্য তিনি পাশে পান তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ের হস্তক্ষেপে ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণের পুরো ৭০ হাজার টাকাই দিতে রাজি হয় তৎকালীন সরকার। চলচ্চিত্রটি ঠিক তখনই আলোর মুখ দেখে। তবে ‘পথের পাঁচালী’র গল্পের শেষে একটা সুখী সমাপ্তির অনুরোধ করেছিল তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার! কিন্তু সত্যজিৎ রায় যে অথর থিউরির অন্যতম মূর্তি, এই অনুরোধ তার মনোমত না হওয়ায় শেষমেশ তা আর ধোপে টেকেনি। ‘পথের পাঁচালী’র নির্মাণের পেছনের গল্পের বিস্তারিত রয়েছে পরিচালকের নিজের লেখা বই একেই বলে শুটিংয়ে।
ভারতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা চলচ্চিত্র, কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ মানব দলিল, বার্লিন ও সানফ্রান্সিসকো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা চলচ্চিত্র, নিউইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্রের খেতাবসহ আরও অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘরে তুলে নেয় ‘পথের পাঁচালী’। শুধু সমালোচকদের সন্তুষ্ট করে নয়, বাণিজ্যিকভাবেও বেশ সফলতা পায় চলচ্চিত্রটি। মুক্তির দুই সপ্তাহে এটি শুধু ভারতেই আয় করে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা!
পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রটি শেষ হয় এক আশা জাগানিয়া মন্তাজ দিয়ে। আর তা হলো অতীত ভুলে নতুন করে বাঁচা, নতুন আগামীর পথে যাত্রা।
আরও পডুন: সত্যজিৎ রায় ও বাংলাদেশ
বাংলাদেশ সময়: ১০২৫ ঘণ্টা, মে ০২, ২০২১
জেআইএম