ঢাকা, শনিবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৭ মে ২০২৫, ১৯ জিলকদ ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

মেঘনায় আবারও মরে ভেসে উঠছে ইলিশসহ বিভিন্ন মাছ

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৩৬, মে ১৬, ২০২৫
মেঘনায় আবারও মরে ভেসে উঠছে ইলিশসহ বিভিন্ন মাছ মেঘনায় পানিদূষণে মরে ভেসে উঠছে জাটকা (ছোট ইলিশ) দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ

চাঁদপুর: আবারও বর্জ্য ও কেমিক্যালযুক্ত পানি ছড়িয়ে দূষিত হয়ে উঠছে চাঁদপুরে মেঘনা নদী। পানিদূষণের কারণে মরে ভেসে উঠছে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।

এতে নদী উপকূলীয় এলাকায় মরা মাছের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিষয়টি তদন্ত হয়েছে। আবারও মাছ মরে যাওয়ার বিষয়টি তদন্ত করতে হবে।

শুক্রবার (১৬ মে) ভোর থেকে জেলার মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে দশানি পর্যন্ত মেঘনা পাড়ের বিভিন্ন স্থানে মাছ মরে ভেসে থাকার এমন চিত্র দেখা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে নদীপাড়ের মানুষজনের মাঝে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

এদিন ভোরে মাছ ধরতে নদীতে নামেন স্থানীয় জেলেরা। তখনই তারা দেখতে পান পানিতে ভেসে রয়েছে অসংখ্য মরা মাছ। বিশেষ করে জাটকা, চেউয়া, বেলে, টেংরা, পুঁটি, চাপিলাসহ অসংখ্য ছোট-বড় দেশীয় মাছ মারা যাচ্ছে। এদিকে পঁচা মাছের দুর্গন্ধে নদীপাড়ের বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। দূষণ হওয়ার কারণে এখন নদীর পানি খাওয়া ও ব্যবহার করতে পারছেন না স্থানীয়রা। কী কারণে বার বার নদীতে মাছ মরে যাচ্ছে এবং পানি দূষণ হচ্ছে, তার সমাধান চান এলাকাবাসী।

দশানি এলাকায় নদীতে জেলের জালে মরা মাছ

এদিকে ইলিশের পোনা জাটকা মরে ভেসে উঠায় চিন্তিত মেঘনা পাড়ে জেলেরা। এভাবে ছোট আকারের জাটকা মারা পড়লে মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাবে কি-না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ডুবেছেন জেলেরা।

ষাটনল এলাকার জেলে পলাশ বর্মন বলেন, এই নদীই আমাদের জীবন। কিন্তু এখন এই পানিতে মাছ তো নেই বরং বিষ ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েক বছর ধরেই এমন হচ্ছে। কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। জাটকাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে মাছ শূন্য হয়ে পড়বে নদী।

দশানি এলাকার বাসিন্দা সেলিনা বেগম বলেন, বাচ্চারা নদীতে খেলতে যায়, গোসল করে। এখন তো মনে হচ্ছে পানিতে হাত দিলেও অসুস্থ হয়ে যাবে। আমরা নদীর পানি সব সময় ব্যবহার করি। কিন্তু এখন পারছি না।

দশানি এলাকার মাছ ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, আজকে যা দেখলাম, তাতে আগামী কয়েক মাস নদী থেকে মাছ পাওয়া কঠিন হবে। বাজারে মাছের দাম বেড়ে যাবে এবং স্থানীয় লোকজন ভুক্তভোগী হবে।

মেঘনায় পানিদূষণে তীরে ভেসে এসেছে চেউয়াসহ ছোট প্রজাতির মাছ

পার্শ্ববর্তী কলাকান্দা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. শামসুদ্দিন বলেন, যেসব এলাকায় মাছ মরে যাচ্ছে, ওই এলাকা পরিদর্শন করেছি। নদীর এই অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক। মাছ মরার এই ঘটনা শুধু পরিবেশের ক্ষতি নয়, মানুষের জীবিকার ওপরও সরাসরি আঘাত। প্রতিদিন শত শত মানুষ এই নদীর ওপর নির্ভরশীল। বারবার অভিযোগ করলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। আমি উপজেলা পরিষদে বিষয়টি তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছি এবং জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ পাঠাব। নদী বাঁচলে আমরা বাঁচব, এটাই এখন সবার মূল দাবি হওয়া উচিত।

মতলব উত্তর উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাস বলেন, এটি নিছক মাছ মরার ঘটনা নয়, এটি একটি জলজ পরিবেশগত দুর্যোগ। শীতলক্ষ্যা থেকে আসা দূষিত পানির প্রবাহ একাধিকবার এই এলাকায় বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এটি প্রথম নয়, একাধিকবার ঘটেছে এমন ঘটনা। ২০২৩ সালের মার্চ ও ২০২৪ সালের আগস্ট মাসেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। তখনও মেঘনার পানি দূষিত হয়ে গণহারে মাছের মৃত্যু হয়। তবে এবার পরিমাণ আরও বেশি দেখা যাচ্ছে।

পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠন ‘মতলবের মাটি ও মানুষ’ এর সভাপতি শামীম খান বলেন, নদীকে কেন্দ্র করে হাজারো পরিবার মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। বারবার দূষণে নদী মৃতপ্রায়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। প্রয়োজন দ্রুত আন্তঃজেলা পরিবেশ কমিশন গঠন এবং কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। মানবিক ক্ষতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিপর্যয় এই ঘটনায় শুধু পরিবেশ নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শত শত জেলে ও মাছ ব্যবসায়ী। নদীর ওপর নির্ভরশীল হাজারো মানুষের জীবিকা এখন হুমকির মুখে।

পরিবেশ অধিদপ্তর চাঁদপুর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, মেঘনা নদীতে মাছ মরে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। সেখানকার প্রতিবেদন অনুযায়ী নদীর পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, পিএইচ ও অক্সিজেনের হার কমে গিয়েছিল। এছাড়া নদীর তলদেশ দিয়ে কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও কেমিক্যালযুক্ত পানি বয়ে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, নতুন করে আবার কেনো মাছ মারা যাচ্ছে, সেটি তদন্ত করে দেখতে হবে। তবে আবারো মাছ মারা যাওয়ার খবর এখনো কেউ জানায়নি। ঘটনাস্থলে গেলে পুরো বিষয়টি জানতে পারব।

এসএএইচ


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।