চে গুয়েভারা ছিলেন একজন আর্জেন্টিনীয় বিপ্লবী, চিকিত্সক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল এর্নেস্তো গেভারা দে লা সের্না (স্পেনীয়: Ernesto Guevara de la Serna)।
তরুণ বয়সে ডাক্তারি ছাত্র হিসেবে চে সমগ্র লাতিন আমেরিকা ভ্রমণ করেছিলেন। এই সময় সব অঞ্চলের দারিদ্র্য তার মনে গভীর রেখাপাত করে। ভ্রমণকালে তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তিনি সিদ্ধান্তে নেন এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণ হল একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। এর একমাত্র সমাধান হল বিশ্ব বিপ্লব। এই বিশ্বাসের থেকেই চে সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
পরবর্তীকালে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের সময় তার সঙ্গে রাউল ও ফিদেল কাস্ত্রোর আলাপ হয়। চে তাদের ২৬ জুলাই আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কিন-মদতপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করার জন্য গ্রানমায় চড়ে সমুদ্রপথে কিউবায় প্রবেশ করেন। সেসময়ই চে বিপ্লবী সংঘের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
চে গুয়েভারা একাধারে ইতিহাসের এক নন্দিত ও নিন্দিত চরিত্র। বিভিন্ন জীবনী, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ, তথ্যচিত্র, গান ও চলচ্চিত্রে তার চরিত্রের নানা দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। টাইম পত্রিকার বিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির তালিকায় তার নাম প্রকাশিত হয়।
১৯৫৯ সালের ১৮ এপ্রিল দুই চীনা সাংবাদিক কুং মাই এবং পিং অ্যান চে গুয়েভারার বাসায় তার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। পিকিং রেডিও এবং নিউ চাইনিজ নিউজ এজেন্সি এই সাক্ষাৎকারের সারাংশ প্রকাশ করলেও চীনের শীর্ষ কোন পত্রিকায় সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়নি। চে গুয়েভারা ভক্তদের জন্য সেই সাক্ষাৎকারেরই কিছু অংশ তুলে দেওয়া হলো।
কিউবাতে বিপ্লবের এই বিজয় কিভাবে সম্ভব হলো?
কিউবার এই বিজয় কিভাবে সম্ভব হলো তা জানতে হলে প্রথমে মেক্সিকোর ২৬ জুলাই হয়ে যাওয়া বিপ্লবে আমার যোগ দেওয়ার গল্প বলতে হবে। আমরা যখন মেক্সিকোতে চলাফেরা করছিলাম তখন দেখেছি সংগঠনের সদস্যরা সমাজকে নানাভাবে দেখে। আমার মনে আছে, একদিন মেক্সিকোতে খোলামেলা এক আলোচনায় আমি কিউবার জনগণের কাছে বিপ্লব করার জন্য একটি উপায়ের কথা বলেছিলাম। তখন আর্মি ক্যাম্প আক্রমণ বিষয়ে এক সদস্যের প্রতিক্রিয়া দেখায়। সে বলে, আমরা যা করতে চাই তা হচ্ছে ক্যু।
বাতিস্তা নিজেও ক্যু করেই ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। আমাদেরও অবশ্যই একটি ক্যু করা উচিত এবং বাতিস্তাকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে ফেলা উচিত। তখন তার সঙ্গে আমার তর্ক হয়। আমি তাকে বলি, কিছু নির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে আমাদের ক্যু করতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে ক্ষমতায় যাওয়ার পর আমরা কি করবো। এই রকমই ছিলো ২৬ জুলাই আন্দোলনের প্রাথমিক স্তরের একজন কর্মীর চিন্তা ভাবনা।
কৃষকরা যারা বাতিস্তার দমন পীড়নের শিকার হয়েছিল তারা ধীরে ধীরে আমাদের দিকে তাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে থাকে। তারা আমাদের গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিতে থাকে। এরই মাধ্যমে আমাদের কর্মীদের মধ্যে শহুরে মানুষ থেকে কৃষকদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে।
কৃষকরাও তাদের অধিকার এবং ন্যায় বিচার আদায়ের লক্ষ্যে সামরিক আন্দোলন শুরু করতে থাকে । আমরা তদের জন্য একটি স্লোগান ঠিক করে রাখি- ভূমি আন্দোলন। এই স্লোগানটি কিউবার মানুষদের সামনে এগিয়ে আনে এবং ভূমি দখল করতে প্রেরণা জোগায়। তারা ভূমি দখলের জন্য লড়তে থাকে। এর মধ্য দিয়েই একটি সামাজিক আন্দোলনের লক্ষ্য ঠিক হয়ে ওঠে এবং পরে এটিই আমাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। হয়ে ওঠে আমাদের প্রতীক।
এরই মধ্যে ঘটে যায় এক দুঃখজনক ঘটনা। সান্টিয়াগো ডি কিউবাতে মারা যান আমাদের কমরেড ফ্র্যাঙ্ক পা। এই ঘটনা আমাদের বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিউবার অতিষ্ঠ জনগণ রাস্তায় নেমে আসে এবং এই প্রথম নিজেরা রাজনৈতিকভাবে হরতালের ডাক দেয়। যদিও তাদের মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার মত কেউ ছিল না। কিন্তু তারপরও বেশ কয়েকটি জায়গা প্রায় অচল করে দেয়। স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী এই আন্দোলনও দমন করে কঠোরভাবে। এই ঘটনার পরেই আমরা বুঝতে পারি, স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ অবশ্যম্ভাবী। এরপর থেকেই আমরা শ্রমিকদের সঙ্গে গোপনে নানা ধরনের কাজ করতে থাকি। আরেকটি হরতালের প্রস্তুতি নিতে থাকি যাতে সেই সময়কে কাজে লাগিয়ে বিদ্রোহীরা ক্ষমতা দখল করতে পারে।
বিপ্লবীদের সুদৃঢ় এবং গোপন কার্যক্রম দেশবাসীর মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। জনগণের মধ্যে সাড়া পড়ে যায় এবং সবাই ৯ এপ্রিলের হরতালের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। কিন্তু হরতালের সময় নেতা এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে যোগাযোগের অভাব থাকায় সাফল্য আসে না।
২৬ জুলাই আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নেতাদের একটি সত্য শেখায়। বিপ্লব কখনো একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর জন্য হতে পারে না। এটা কিউবার সবাইকে ধারণ করে। এই সারকথাটি আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে সাড়া জাগায়। তারা সমতলে এবং পাহাড়ে সব জায়গায় সমানভাবে কঠোর পরিশ্রম করতে থাকে। এরই মধ্যে আমরা আমাদের সঙ্গে যারা ছিল তাদেরকে বৈপ্লবিক তত্ত্ব এবং মতবাদের শিক্ষা দিতে থাকি। এর ফলেই আমরা বুঝতে থাকি বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে এবং সময় হয়েছে রাজনৈতিক পরিপক্কতা অর্জনেরও।
সিয়েরা মায়েস্ত্রো এবং অন্যান্য জায়গায় বিপ্লবী আর্মির সদস্যরা তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব মনে রেখে সেই মত কাজ করছিলো। কৃষকদের অবস্থার উন্নতিতে সহায়তা করা, ভূমি দখল এবং স্কুল নির্মাণে সহযোগীতা করাই ছিলো তাদের মুল কাজ।
অ্যাগ্রেরিয়ান আইন প্রথমবারের মত চালু করা হয়। বিপ্লবী পদ্ধতিতে আমরা স্বৈরাচারী শাসকদের সব পদগুলো দখল করে নেই এবং রাষ্ট্রের জমিগুলো কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করতে শুরু করি। সেই সময়েই সেখানে একটি কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে যার মূল বক্তব্য ছিলো ‘ভূমি সংস্কার’। এখন যেসব কৃষকেরা স্বাধীনতা পেয়েছেন তাদের অবশ্যই এক হয়ে গণতান্ত্রিকভাবে লাতিফুনদিয়া ব্যবস্থার রদ এবং ভূমি সংস্কারের জন্য দাবি তুলতে হবে।
কিউবার এই বিপ্লব এখন কি কি সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে?
প্রথম সমস্যা হচ্ছে আমাদের সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে। জনগণ-বিরোধী শাসনব্যবস্থা এবং আর্মি যদিও ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু তারপরও স্বেচ্ছাচারী সমাজ ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক ভিত্তিগুলোর এখনও পরিবর্তন হয়নি। কিছু কিছু মানুষ এখনও আগের সেই ব্যবস্থাতেই কাজ করে যাচ্ছেন।
বিপ্লবের ফলাফল ধরে রাখতে হলে আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের কাজ করতে হবে একটি কার্যকর সরকারের জন্য। দ্বিতীয়ত নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পরে দেখা গেলো সব জায়গাতেই ধ্বংসস্তূপ। বাতিস্তা পালিয়ে যাওয়ার সময় জাতীয় কোষাগার থেকে সব কিছু নিয়ে গেছে। অর্থনীতিতে রয়েছে ভয়াবহ সব সমস্যা।
তৃতীয়ত, তখন দেশে বেকার সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশটিতে তখনও জাতিগত দাঙ্গা চরমভাবে বিরাজ করছে। আমাদের বাড়ি ভাড়া ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ ভাড়া। একজন মানুষের উপার্জনের এক তৃতীয়াংশই দিতে হতো বাড়ি ভাড়া। সব কিছু মিলিয়ে দেখা গেলো কিউবার অর্থনৈতিক সমস্যা এতোই প্রবল যে তা ঠিক করা খুবই কষ্টকর এবং সময় সাপেক্ষ হয়ে যায়।
কিউবা কিভাবে তাদের নিজেদের এবং বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শত্রুদের মোকাবেলা করবে? বিপ্লবের মাধ্যমে পাওয়া এ বিজয়ের সম্ভাবনাগুলো কি কি?
কিউবার এই বিপ্লব শ্রেণী সংগ্রাম ছিল না। এটি ছিল স্বাধীনতার বা মুক্তির সংগ্রাম যা অত্যাচারী এবং নৃশংস সরকারকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। জনগণ আমেরিকা সমর্থিত এ বাতিস্তা সরকারকে মনে প্রাণে ঘৃণা করতো। এজন্যই তারা এক হয়ে তাকে গদি থেকে নামিয়ে এনে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে।
যারা মুলধন হাতের মুঠোয় রাখে এবং ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টে যাদের প্রতিনিধি রয়েছে একমাত্র তারাই কিউবার এই বিপ্লবের বিরোধিতা করে। বিপ্লবের ফলে এই বিজয় এবং কিউবার বিপ্লবের ক্রমাগত উন্নতি দেখে তাদের মধ্যে হিংসার সৃষ্টি হয়। তারা সহজেই এই পরাজয়কে মেনে নিতে পারছিল না।
প্রতিটি লাতিন দেশে আমাদের এই বিপ্লব একটি উদাহরণ স্থাপণ করে ফেলেছে। আমাদের এই বিপ্লবের অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষা কফি হাউজের সিগারের ধোয়ার মত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আমরা প্রমাণ করে দিয়েছিলাম অকুতোভয় এবং দৃঢ় চিত্তের একটি ছোট দলও পারে বিপ্লবের সূচনা করতে। দরকার শুধু সাধারণ মানুষের সাহায্য। যারা লড়তে পারবে শেষ পর্যন্ত।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১২
সম্পাদনা: শেরিফ আল সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক