ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

প্রত্যেকেই নিজের শিক্ষক: সুগতা মিত্র

স্বপ্নযাত্রা ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:৪৪, জুন ২, ২০১২
প্রত্যেকেই নিজের শিক্ষক: সুগতা মিত্র

সুগতা মিত্রকে দেয়াল ভেদের কারিগর বলা হয়। বিষয়টি মজার।

তিনি দেয়াল ভেঙ্গে সেখানে কম্পিউটার আটকিয়ে দেন। এরপর কম্পিউটারে দেওয়া হয় ইন্টারনেট সংযোগ। নয়া দিল্লি থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইতালির বিভিন্ন জায়গায় তিনি এ গবেষণা পরিচালনা করেন। তার মূল উদ্দেশ্য হলো শিশুদের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া। এ থেকে শিশুরা নিজেরাই কম্পিউটার শেখার সুযোগ পায়। এ ঘটনাটি সুগতা মিত্রের কাছে শিশু বিপ্লবের মতো।  

অধ্যাপক সুগতা মিত্র একজন বিজ্ঞানী ও শিক্ষক। তিনি নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যায়ে শিক্ষা, যোগাযোগ ও ভাষা বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। এর সঙ্গে শিক্ষা বিষয়ক গবেষণার জন্য দেয়াল ভাঙার কারিগর হিসেবে তিনি সুপরিচিতি পেয়েছেন। এ অসাধারণ মানুষটি ২০১০ সালের টেডএক্স সম্মেলনে স্বশিক্ষা বিষয়ে বক্তৃতা দেন। এখানে বক্তৃতার কিছু অংশ তুলে দেওয়া হলো।

আপনার দেশের মানচিত্রের দিকে তাকান। তারপর আপনি ছোট ছোট বৃত্ত এঁকে বলে দিতে পারবেন কোন কোন জায়গাগুলোতে ভালো শিক্ষক যাবেন না।  

মনে রাখবেন, সেই জায়গাগুলো থেকেই কিন্তু সমস্যার তৈরি হয়। যেসব জায়গাতে শিক্ষকের প্রয়োজন সেখানেই তারা যান না।

আমি ১৯৯৯ সালে একটি গবেষণা শুরু করি। আমি নয়া দিল্লির এক বস্তির দেয়ালে কম্পিউটার আটকিয়ে দিয়েছিলাম। সে  এলাকায় তেমন কোনো স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়ে ছিল না। ওরা ইংরেজিও জানত না। শুধু তাই নয়; আগে কোনদিন কম্পিউটারও দেখেনি, ইন্টারনেট কি জিনিস তাও জানে না।

আমি কম্পিউটারের সঙ্গে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবস্থা করে দিলাম। কম্পিউটারটি মাটি থেকে মোটামুটি তিন ফুট উঁচুতে ছিল। সেখানে কম্পিউটারটি চালিয়ে দিয়ে রেখে চলে আসলাম। এরপর থেকেই আমরা কিছু মজার ব্যাপার খেয়াল করলাম। আমি এই পরীক্ষাটি ভারতজুড়ে বারবার করেছি। তারপর বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়ও করে দেখেছি। সব জায়গাতেই দেখলাম, বাচ্চারা যা শিখতে চায় তাই তারা শিখে নিতে পারে।

রাজস্থানের একটি গ্রামে বাচ্চারা নিজেরাই নিজেদের গান রেকর্ড করেছে। তারপর একে অন্যকে বাজিয়ে শুনিয়েছে। এ কাজটা করতে বাচ্চারা মজাও পেয়েছে। শিশুদের দল কম্পিউটার আর ইন্টারনেট থেকে নিজেরাই শিখতে পারে। তারা কোথায় আছে কার সঙ্গে আছে এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

গবেষণার এসব ফলাফলে আমি আশাবাদী হয়ে উঠলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম শিশুরা কম্পিউটার দিয়ে আর কী করতে পারে তা পরীক্ষা করে দেখা। আমরা তখন ভারতের হায়দ্রাবাদে অরেকটি পরীক্ষা শুরু করলাম। সেখানে শিশুদের দেখলাম তেলেগু টানে ইংরেজি বলে। তাদেরও একটা কম্পিউটার দিলাম। সঙ্গে দিলাম কথা-থেকে-লেখা যায় এমন সফটওয়্যার। সফটওয়্যারটি এখন উইন্ডোজের সঙ্গে বিনামূল্যে পাওয়া যায়।

কম্পিউটারটি পেয়েই ওরা নানান কথা বলা শুরু করল। সফটওয়্যারটিও ব্যবহার করার চেষ্টা শুরু করল। আমি তাদের বললাম, কম্পিউটারটি এখানে দুমাসের জন্য রেখে যাচ্ছি। তোমরা নিজেদের কথাগুলো কম্পিউটারকে বোঝাও। ’ তখন বাচ্চারা বলল, আমরা সেটা করব কিভাবে?’ আমি বললাম, ‘আমি আসলে জানিনা। ’

দুমাস পর ওদের সবার উচ্চারণের ধরন বদলে গিয়েছে। অদ্ভুতভাবে তা নিরপেক্ষ ব্রিটিশ উচ্চারণের খুব কাছাকাছি চলে যায়। তাহলে কি দাঁড়ালো? বাচ্চারা নিজে নিজেই এ কাজটি করতে পারে।

একবার কলম্বো থেকে আমি অদ্ভুত কল পেলাম। আর্থার সি ক্লার্ক ফোনটি করেছিলেন। কার্ক বললেন, ‘ কোনো মেশিন যদি কোনো শিক্ষকের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে, তবে তাই হওয়াই উচিত। ’ দ্বিতীয় কথাটি ছিল আরও মজার। তিনি বললেন, ‘শিশুদের যদি আগ্রহ থাকে তাহলে শিক্ষা নিজেই শিখে নিতে পারে। ’

তামিল ভাষাভাষী ১২ বছর বয়সের শিশুরা ইংরেজিতে নিজে নিজে বায়োটেকনলজি শিখতে পারে কিংবা শেখাতে পারবে? আমি ভাবলাম, এর একটা পরীক্ষা হয়ে যাক। ওরা হয়ত শূন্য পাবে। তারপরও শেখার মতো সবকিছু দিয়ে আসব। তারপর আমি ফিরে এসে পরীক্ষা নেব। ওরা আবার শূন্য পাবে।

আমি সেই গ্রামে গিয়ে ২৬ জন শিশুকে ডাক দিলাম। তারপর বললাম এটি কম্পিউটার। এখানে অনেক কঠিন বিষয়ের তথ্য আছে। তোমরা সেগুলো নিয়ে পড়। কিছুই যদি না বোঝো কোনো আপত্তি নেই। আর একটা বিষয় মনে রেখো, এখানে কিন্তু সবকিছুই ইংরেজিতে।

তো এভাবে আমি কম্পিউটারটি রেখে চলে এলাম। দুমাস পর ফিরে গেলাম। সেই ২৬ জন বাচ্চা আমাকে দেখেই দৌড়ে এলো। সবাইকে খুব বেশি শান্ত দেখাচ্ছিল। আমি প্রশ্ন করলাম, ‘তোমরা কি ওই জিনিসগুলো দেখেছিলে?  ওরা বলল, ‘হ্যা, আমরা দেখেছি’। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, ‘তোমরা কি কিছু বুঝতে পেরেছো?’ উত্তরে সবাই বলল, ‘না, কিছুই বুঝিনি। ’

আমি তখন বললাম, ‘যাই হোক, তোমরা কত দিন ধরে জিনিসগুলো দেখে সিদ্ধান্ত নিলে যে তোমরা কিছুই বোঝনি?’ ওরা বলল, ‘ওগুলো আমরা প্রত্যেকদিনই দেখি। ’ তো আমি বললাম, ‘তাহলে গত দুমাস ধরে তোমরা একটা জিনিস দেখছ যার কিছুই তোমরা বোঝনি?’  তখন একটা ১২ বছর বয়সী মেয়ে হাত তুলে বলে, ‘আসলে ডিএনএ অনুগুলোর অস্বাভাবিক প্রতিলিপি তৈরি হলে জেনেটিক রোগ হয়,  এটা ছাড়া আমরা আর কিছুই বুঝিনি। ’

যাইহোক ওদের স্কোর শূন্য থেকে ৩০ হলো। যদিও ৩০ শতাংশ পাশ নম্বর নয়।

আমি খেয়াল করলাম, ওদের এক বন্ধু আছে। যে স্থানীয় হিসাবরক্ষক। খুব বড় সে না। আমি সেই মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি ওদেরকে পাশ করার মত বায়োটেকনলজি শিখাতে পারো?’ সে অবাক হয়ে বলল, ‘আমি কিভাবে শিখাব?
আমি ওই বিষয়ে কিছু জানিনা তো। ’ আমি বললাম, ‘এক্ষেত্রে দাদিমাদের পদ্ধতি কাজে লাগাতে হবে। তোমাকে ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে শুধু প্রসংশা করে যেতে হবে। ওদেরকে শুধু বলবে অসাধারণ হচ্ছে। কী জিনিস এইটা? আবার করতে পারবে? আমাকে এমন আরও কিছু দেখাতে পারবে?’

সেই হিসাবরক্ষক মেয়েটি দুই মাস ধরে এ কাজটি করল। তারপর বাচ্চাদের স্কোর পৌঁছাল ৫০ শতাংশে।

শেষে বলতে চাই, শিক্ষা একটি স্ব-সংগঠিত ব্যবস্থা।   যেখানে শেখার বিষয়টি কোথা থেকে উঠে আসে তা বের করতে হলে  গবেষণার প্রয়োজন। কিন্তু আমি চেষ্টা করব এরই মধ্যে।

সময়: ১৮২৫ ঘণ্টা, জুন ২, ২০১২
সম্পাদনা: শেরিফ আল সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক ও সাব্বিন হাসান

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।