কলকাতা: বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ, সীমান্ত শহর বনগাঁ এবং লক্ষ্মী সায়গল বাঁধা রইলেন এক ফ্রেমে। ২৬ মার্চ ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধ শুরু।
ক’দিন যেতে না যেতেই সহায় সম্বলহীন শরণার্থী মানুষের ভিড়ে কানায় কানায় পূর্ণ এ মহকুমা। কোনো পতিত জায়গা আর খালি ছিল না। বনগাঁবাসীর আন্তরিকতায় গড়ে ওঠছে একটার পর একটা শরণার্থী শিবির। খোলা হয়েছে লঙ্গরখানা। এপ্রিলের প্রথমদিকের শিবিরগুলিতে তখন ভেঙে পড়ছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।
সিপিএমের সংগঠন পিপলস রিলিফ কমিটির (পিআরসি) চিকিৎসক, কর্মীরা সাধ্যমতো ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আগত মানুষের মিছিল তখনো থামেনি। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় ছাপা হওয়া সেদিনকার খবর পড়ে তামাম ভারতবর্ষের মানুষ শিউরে উঠেছিলেন।
স্থির থাকতে পারেননি এক ক্যাপ্টেনও। তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনীর সৈনিক। সুভাষচন্দ্র বসুর সহযোদ্ধা। তিনি ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সায়গল। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেয়ে দ্রুত যোগাযোগ করেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সঙ্গে। কিন্তু তার আবেদন নাকচ হয়ে যায়। হার মানেননি সেদিন। যোগাযোগ হয়েছিল প্রয়াত জননেতা জ্যোতি বসুর সঙ্গেও। তিনিই সুযোগ করে দেন।
মে মাসের প্রথম পক্ষেই চিকিৎসক হিসাবে বাংলাদেশে সীমান্তবর্তী শহর বনগাঁয় পা রেখেছিলেন ক্যাপ্টেন সায়গল। দক্ষিণ ভারতীয় এই সমাজসেবীকে নিয়ে প্রথমে দ্বিধায় ছিলেন বনগাঁর পিআরসির কর্মী, চিকিৎকরা। দক্ষিণ ভারতীয় খাদ্যের সমস্যা, ভাষার কি হবে! সেদিন তাঁদের আশ্বস্ত করেছিলেন তৎকালীন সিপিএম নেতা শান্তিময় ঘোষ।
ইছামতীর ধার ঘেঁষেই গেছে বাগদা রোড। এখন শ্যামা অটোমোবাইলস নামে যে পেট্রোল পাম্পটি রয়েছে তার ঠিক পিছনেই সতীশ মুখার্জির বাড়ি। এই বাড়ির একতলার একটি ঘর তাঁর জন্য বরাদ্দ করা হয়। সুকুমার হাজরা ছিলেন তাঁর দেখাশোনার দায়িত্বে। পিআরসির ক্যাম্পও ছিলো ওই রাস্তায়।
যেটা এখন বাদল কুণ্ডুর গ্যারেজ নামে এলাকার সবাই চেনেন। টালির ছাউনি দেওয়া ইটের দেওয়াল ঘেরা একটি ঘরে, একটি বেড নিয়ে চলছে পিআরসির ক্যাম্প। হ্যাঁ, চিকিৎসক হিসাবেই কাজ শুরু করে মন জয় করে নিয়েছিলেন লক্ষ্মী সায়গল।
ভাষা আলাদা হলেও সেদিন কোনো সমস্যা হয়নি বলেই জানালেন গণ আন্দোলনের নেতা দুলাল মণ্ডল। পিআরসির কর্মীদের কাছেও তিনি ছিলেন মধ্যমণি। একেবারে সময় মেপে তাঁর আসা, যাওয়া ছিলো ছকে বাঁধা। বনগাঁয় ছিলেন একমাস। কোনোদিন ব্যতিক্রম হয়নি। চিকিৎসা করার সময় অন্য কিছু ভাবতেনই না।
বনগাঁ হাটখোলার সামনে তখন ছিল পাঞ্জাবি হোটেল। কিছু যাত্রী, বাসকর্মীরাই মূলত সেখানে খাওয়া-দাওয়া করতেন। সেখান থেকে নিয়মিত খাবার যেতো ক্যাপ্টেন সায়গলের জন্য। মূলত রুটিই বেশি পছন্দ করতেন। আর বাঙালি খাবারও রপ্ত করে নিয়েছিলেন বেশ।
সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটির সদস্য রঞ্জিত মিত্র জানালেন, সীমান্ত পেরিয়ে ১৮ লাখ মানুষ এসেছিলেন। ঐ সময় ছয় লাখ মানুষকে পিআরসির পরিষেবা দেওয়া হয়। কলকাতার ২৪৯ বউবাজার স্ট্রিটে ছিল পিআরসির কার্যালয়। প্রমথ চক্রবর্তীর মাধ্যমে নিয়মিত ওষুধ যেত বনগাঁয়।
দুলাল মণ্ডল জানিয়েছেন, উনি থাকাকালীন যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় ২৮ হাজার শরণার্থী মানুষকে চিকিৎসা করা হয়। কোনো অসুস্থ বা গুলিবিদ্ধ মানুষ এলে তাঁর আন্তরিকতা ছিল দেখার মতো।
এই একমাসেই ক্যাম্পে যে নারী কর্মীরা কাজ করতেন তাদের অনেককেই ছোট খাটো ওষুধ, ইঞ্জেকশান দেওয়াও শিখিয়েছিলেন। সেদিনকার পরিচিতরা জানিয়েছেন, কানপুরে থেকেও বনগাঁর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি। এখান থেকে কেউ গেলে মেতে উঠতেন স্মৃতি চারণে। বনগাঁ আর মুক্তিযুদ্ধ তাঁর হৃদয়ে উজ্জ্বল ছিল আজীবন।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০১২
আরডি/সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর