ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

মধুপুরে আদিবাসী গারোদের আদর্শ ‘প্রতিভা দিদি’

সুমন কুমার রায়, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৫২, আগস্ট ৩, ২০১২
মধুপুরে আদিবাসী গারোদের আদর্শ ‘প্রতিভা দিদি’

টাঙ্গাইল: তিনি এলাকার সবার কাছে ‘প্রতিভা দিদি’ নামেই পরিচিত। বয়স আনুমানিক ৮০ বছর।

চশমা ছাড়াই তিনি বেশ পরিস্কার দেখেন। এখনও তিনি বিভিন্ন গল্পের বই ও পত্রিকা পড়ে অবসর সময় কাটান। এখনও তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেন কেউ স্কুল ফাঁকি দিয়ে বাড়িতে বসে আছে কিনা, কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে কিনা ইত্যাদি।

গারো নারীদের সংগ্রামী এ অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহিয়সী নারীর নাম- প্রতিভা সাঙ্গমা-‘প্রতিভা দিদি’। এলাকার ছোট-বড় সবাই তাকে প্রতিভা দিদি নামেই চেনে ও জানে।

জীবনের শুরু থেকেই সবার ‘প্রতিভা দিদি’ আদিবাসী গারোদের সনাতন সমাজব্যবস্থা, শিক্ষা আর সংস্কৃতির উন্নয়নে সংগ্রাম চালিয়ে এসেছেন এবং বৃদ্ধ বয়সে আজও তিনি তার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন অটুট মনোবল নিয়ে।

চিরকুমারী এই মহিয়সী নারী এখনও প্রায় প্রতিদিনই এক কিলোমিটার হেঁটে চা পান করতে ইদিলপুর বাজারে যান। সেখানেও তিনি বিভিন্ন শিখনীয় বিষয়ে এলাকার অনেকের সঙ্গেই চুটিয়ে আড্ডা জমান।

মহিয়সী এ নারীর পরামর্শ গ্রহণ করে এলাকার লিপি দফো (৪০), হাছনা (২৫), পারুল (২০), মহিমা মৃসহ (২২) অনেকেই তাদের কর্মজীবন ও সাংসারিক জীবনে সফল হয়েছেন।

প্রতিভার দিদির অনুপ্রেরণায় সফল হয়েছেন এমনই এক নারী হলেন লিপি দফো। তিনি এক বাক্যে প্রতিভা দিদির কৃতজ্ঞতার কথা বাংলানিউজের কাছে স্বীকার করে বলেন, ``বিভিন্ন দরকারে প্রতিভা দিদির পরামর্শ নিয়েছি। তার পরামর্শ, অনুপ্রেরণা, উৎসাহ ও সৎ সাহসিকতা নিয়ে আমি নিজেই বড় হয়েছি। তার পরামর্শের কারণে আজ আমার দুই ছেলেই স্কুলে পড়াশোনা করতে যায়। ”

এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এরকম অনেক পরিবারের ছেলে-মেয়ে আজ স্কুলে যাচ্ছে শুধু মাত্র প্রতিভা সাঙ্গমার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার কারণে। জীবনের শেষের দিকে এসে তিনি আজও এলাকার মানুষের খোঁজখবর রাখেন।

প্রতিভা সাঙ্গমা ১৯৩৩ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার পাহাড় আর বন ঘেরা ইদিলপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

বাবার নাম সনাতন মৃ, মা অন্বেষা সাঙ্গমা। ৪ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। সে সময় পশ্চাৎপদ গারো সমাজে লেখাপড়ার প্রচলন ছিলনা বললেই চলে। পাহাড়ি এলাকায় তো দূরের কথা, খোদ মধুপুর উপজেলা সদরে তখনও কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলনা। মাতৃপ্রধান গারো সমাজে তার মা অন্বেষা সাঙ্গমা আদিবাসী সংস্কৃতির একজন উৎকৃষ্ট সমঝদার ছিলেন।

তিনি জঙ্গল আর পাহাড় ঘেরা গ্রামে আর দশটি আদিবাসী মেয়ের মতো প্রতিভা সাঙ্গমাকে নিরক্ষর রাখেন নি। সংসারে অনটন থাকা সত্বেও প্রতিভাকে ময়মনসিংহ শহরের বিদ্যাময়ী হাইস্কুলে ভর্তি করান মা অন্বেষা সাঙ্গমা।

১৯৪৯ সালে প্রতিভা এ স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিকুলেশন (এসএসিসি) পাস করেন। পরবর্তীতে আনন্দমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট (এইচএসসি) পাস করেন তিনি।

এরপর ১৯৫২ সালে প্রথমে ময়মনসিংহ শহরের হলিফ্যামিলি হাইস্কুলে এবং পরে হালুয়াঘাট উপজেলার সেইন্ট মেরি মিশনারি হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। শিক্ষকতার পাশাপাশি আদিবাসী গারো সংস্কৃতি উন্নয়নের জন্যও কাজ করেন প্রতিভা সাঙ্গমা।

১৯৫৩ সালে প্রতিভা গার্লস গাইডের নেত্রী হিসেবে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে পাকিস্তানের পেশোয়ারে যান। এরপর ১৯৭১ সালে শিক্ষকতার চাকরিতে থাকাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি।

এসময় তিনি দেশ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার মনস্থ করেন। গার্লস গাইডের প্রশিক্ষণকে এ সময় কাজে লাগান প্রতিভা সাঙ্গমা। ক্রিশ্চিয়ান অর্গানাইজেশন ফর রিলিফ অ্যান্ড রিহেবিলিটেশনের (বর্তমানে কারিতাস) সহযোগিতায় মধুপুর উপজেলার জলছত্র খ্রিস্টান মিশন হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে চিকিৎসা দেন তিনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও তিনি শিক্ষকতা পেশায় ফিরে যান।

১৯৭২ সালে মধুপুর উপজেলা সদরে গার্লস হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা হলে তিনি সেখানে শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। প্রতিদিন বাড়ি থেকে ৫ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে এবং বাকি ৬ কিলোমিটার রাস্তা রিকশায় চেপে স্কুলে আসতেন প্রতিভা সাঙ্গমা।

একটানা ৪০ বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৯১ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন তিনি।

এসময় শিক্ষকতার পাশপাশি প্রতিভা সাঙ্গমা নিজ সম্প্রদায়ের মেয়েদের স্কুলমুখি করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। গারো হেডম্যানদের বুঝিয়ে অবহেলিত গারো মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার বিস্তার এবং শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। খ্রিস্টান মিশন এবং আদিবাসী গারো নেতাদের সহযোগিতায় মধুপুর পাহাড়ি অঞ্চলে বেশ কয়েকটি মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন।

প্রতিভা সাঙ্গমার বয়স এখন আশির কোঠায়। এ বয়সেও তার সেই মহৎ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এখনও তিনি নিজ গ্রাম ইদিলপুরের আদিবাসী গারো মহল্লায় নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন কোনো গারো শিশুর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হলো কিনা, অথবা অসুস্থ হয়ে কেউ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে কিনা! পাড়ার দরিদ্র আদিবাসী গারো শিশুদের এখনও তিনি বিনাবেতনে পড়াশোনা করান।

তাদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায় উজ্জীবিত হওয়ার পরামর্শ দেন। বর্তমানে এ গ্রামে একটি মিশনারি স্কুল, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যলয়, একটি শিশুপল্লী ও শিক্ষায়তন এবং হাইস্কুল রয়েছে।

গ্রামের ছোট ছোট শিশুদের সঙ্গে তার একটা আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। তার অনেকটা সময় কেটে যায় ওইসব শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা আর গল্পগুজব করে। `শিক্ষা ছাড়া আদিবাসী গারোদের মুক্তি নেই` তার এই স্লোগান ইদিলপুরের গারো কমিউনিটিকে উদ্বুদ্ধ করেছে।

ওই গ্রামের দুই শতাধিক আদিবাসী গারো পরিবারে আর কোনো নিরক্ষর মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবেনা।

`প্রতিভা দিদি` পরিবার পরিকল্পনার বর্তমান পদ্ধতিগুলোর ঘোরবিরোধী। তিনি ন্যাচারাল ফ্যামেলি প্ল্যানিং বা নৈসর্গিক ফ্যামেলি প্ল্যানিংয়ে বিশ্বাসী। তার পরামর্শ মতে, অনেকেই এ পদ্ধতি গ্রহণ করছেন বলেও বাংলানিউজকে জানান তিনি।

তার পাশের গ্রাম গুবুদিয়ায় বহু বিবাহ আর বহু সন্তানের সংসার থাকলেও তার গ্রাম ইদিলপুরে দুইয়ের অধিক সন্তান নেওয়া পরিবারের সংখ্যা নেহায়েত কম। বাল্যবিবাহ তার একেবারেই অপছন্দ। তাই, সব তরুণ-তরুণীদের ও অভিভাবকদের বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে অবহিত করেন হরদম।

নববধূ অথবা বিয়ের বয়েসী মেয়েদের দুইয়ের অধিক সন্তান না নিতে পরামর্শ দেন। সন্তান হলে কীভাবে যত্ম নেওয়া হচ্ছে, তার খোঁজখবরও নেন তিনি।

লিপি দফো বাংলানিউজকে জানান, দুই সন্তান হয়ে গেলেই প্রতিভা দিদির একটিই কথা- `আর সন্তান নিসনা। এই দুইজনকে মানুষের মতো মানুষ কর। প্রকৃত মানুষ বানা। `

এ বয়সেও প্রতিভা দিদির কোনো অসুখ-বিসুখ নেই। কখনো ওষুধ খেতে হয়না। স্বামী সন্তানহীন প্রতিভা সাঙ্গমা কখনও নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করেন না। কারণ, গ্রামের সব শিশুরাই তার সন্তান। সব পড়শিরাই তার আপনজন। সবার সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নেওয়ায় কখনো নিঃসঙ্গবোধ তাকে তাড়া করে না।

তবে গারো শিশুরা এখনও গারো ভাষায় পড়াশোনা করতে পারে না, এটি তার জন্য বড়ই কষ্টের।

গারোদের অপর নাম `মান্দি`। তাদের ভাষার নাম `আচিক`। বর্ণমালার অভাবে গারো ভাষার কোনো লেখ্য রূপ নেই। গারোরা মুখে মুখে এ ভাষা ব্যবহার করে তাদের ভাব প্রকাশ করেন। বর্ণমালা না থাকায় তারা শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং প্রাত্যহিক প্রয়োজনে তাদের অনুভূতিকে লেখ্য রূপ দিতে পারেননা।

প্রতিভা সাঙ্গমা বাংলানিউজকে জানান, একটি গারো শিশু বাড়িতে নিজ ভাষায় কথা বলে। স্কুলে গিয়ে বাংলা ও ইংরেজিতে পড়াশুনা করতে হয়। এক সঙ্গে ৩টি ভাষায় পড়াশুনা বা প্রাত্যহিক কাজ সারতে গিয়ে তাদের ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ পড়ে। তাই, তাদের মাতৃভাষা উন্নয়নের জন্য সরকার ও সমাজের সবারই ভূমিকা রাখা উচিত।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪২ ঘণ্টা, আগস্ট ০৩, ২০১২
সম্পাদনা: মাহাবুর আলম সোহাগ, নিউজরুম এডিটর, আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।