বঙ্গবন্ধু একজন নেতা। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কাব্যিক শক্তি এদেশের মানুষকে বারবার অনুপ্রাণিত করেছে।
আমার লেখার বিষয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নিয়ে। তবে চমৎকার একটি বিষয় হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটিতে বঙ্গবন্ধু ‘হিরো’ নন। তার জীবনীগ্রন্থের নায়ক হলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। যা সাধারণ আত্মজীবনীগ্রন্থে খুব একটা দেখা যায় না।
সুখপাঠ্য বইটির অধিকাংশ অধ্যায় জুড়ে সোহরাওয়ার্দীর কথাই বলতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তার রাজনৈতিক জীবনে শহীদ সাহেবের প্রভাব যে কতটা স্পষ্ট তা বইটি পড়লেই পাঠকের সামনে ঝকঝকে হয়ে উঠবে।
আত্মজীবনীর শুরুতেই তিনি বলে ফেলেন, ‘…ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট্ট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তাঁর সাথে আমার পরিচয় হলো। কেমন করে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। কিভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তাঁর স্নেহ আমি পেয়েছিলাম। …’
শহীদ সাহেবের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা ফুটে ওঠে এই লাইনগুলোর মধ্যে দিয়েই।
বইয়ে নিজ পরিবারের পরিচয়পর্ব থেকে শুরু করে শহীদ সাহেবের সঙ্গে পরিচয় পর্বটিও স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন বঙ্গবন্ধু। শহীদ সাহেবের সঙ্গে তার পরিচয় হয় ১৯৩৮ সালে। একসঙ্গে দুই নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ আসেন। সেখানেই পরিচয় পর্ব দিয়ে রাজনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র শেখ মুজিবুর রহমানের যাত্রা শুরু। এরপর সেই কলেজ ছাত্র ধীরে ধীরে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
পাকিস্তান আন্দোলনের বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা স্পষ্ট। সেসময়কার মুসলমানদের একমাত্র দাবি ছিল ‘পাকিস্তান’ নামে আলাদা রাষ্ট্র। আর সেই দাবী প্রতিষ্ঠায় যে ভূমিকা তার ছিল তা তিনি খুব সহজেই বলে গেছেন। এমনকি সেখানেও শহীদ সাহেবের ভূমিকার স্পষ্ট বর্ণনা দেন বঙ্গবন্ধু। তবে এসব বর্ণনা তার নিজের ব্যক্তিগত মতামত হিসেবেই ধরে নিতে হবে।
আত্মজীবনী গ্রন্থখানি সম্পাদনা কাজে জড়িত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। একইসঙ্গে বইটির ভূমিকা লিখেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই ভূমিকাটি তিনি লিখেছেন জেলে থাকা অবস্থায় ২০০৭ সালে। এ নিয়ে আমার একখানা মতামত হলো, নেতারা সবসময় জেলে বসেই লিখতে পছন্দ করেন। নিজের মতো করে সময় পান। যা তারা লেখালেখিতে হয়তো ব্যয় করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূমিকার এক জায়গায় বলেছেন, ‘এ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত আত্মজীবনী লিখেছেন। ১৯৬৬-৬৯ সালে কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দি থাকাকালে একান্ত নিরিবিলি সময়ে তিনি লিখেছেন। ’
বলাই যায়, বঙ্গবন্ধুও আত্মজীবনী লিখেছেন কারাবন্দি থাকা অবস্থায়।
যাইহোক, যে কথা বলতে চেয়েছিলাম সেটা হলো বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী গ্রন্থে বহুবার চৌধুরী সাহেবের প্রসঙ্গ এসেছে। এই চৌধুরী সাহেব হলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী। সম্পাদনার ভালো দিকটি হলো, সম্পাদক চাইলে বইয়ে এই বিতর্কিত লোকটির চরিত্র ম্যানুপুলেট করতে পারতেন। কিন্তু সেটা হয়নি। বরং স্বচ্ছভাবেই চৌধুরী সাহেবের কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন তার কথা প্রথম আসে ‘অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগ’- এর সভাপতি ওয়াসেক সাহেবের সূত্র ধরে। এই ওয়াসেক সাহেবের সঙ্গে ফজলুল কাদের চৌধুরীর সব সময় বিরোধ লেগে থাকতো। ওয়াসেক সাহেব একচেটিয়ে রাজনীতি করতে চাইতেন। তাই তার সঙ্গে বিরোধ। একবার এক গন্ডগোলে চৌধুরী সাহেবের দলকে বঙ্গবন্ধু সমর্থন জানিয়ে প্রতিবাদেও অংশ নেন। এমনকি চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে ভারত ঘুরার বর্ণনাও আছে বইটিতে। তবে চৌধুরী সাহেব সম্পর্কে এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু মন্তব্য করেন,
‘চৌধুরী সাহেব খুবই স্বার্থপর হয়ে ওঠেন এবং একগুঁয়েমি করতেন, সেজন্য যারা তাকে চট্টগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, পরে তারা সকলেই তাঁকে ত্যাগ করেন। ’
রাজনৈতিক কুটচাল, পার্টি ম্যানুপুল্যাশন, টাকার খেলা, দল বদলানো, মানুষের নতুন চেহারা উন্মোচন এসবই পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে। সঙ্গে আছে দূর্ভিক্ষ এবং হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটও উঠে আসে বইয়ে। শুধু তাই নয়, কলকাতা ও সিলেট নিয়ে যে রাজনীতি ব্রিটিশরা করেছে সে বর্ণনাও আছে। কলকাতাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী না করে ভারতের সীমানায় দিয়ে দেওয়াটা হঠকারিতার সামিল বলেই বোঝা যায়।
কলকাতা পূর্ব বাংলার হাতছাড়া নিয়ে বঙ্গবন্ধু বইয়ে উল্লেখ করেন,
...নেতারা যদি নেতৃত্ব দিতে ভুল করে, জনগণকে কার খেসারত দিতে হয়। যে কলকাতা পূর্ব বাংলার টাকায় গড়ে উঠেছিল সেই কলকাতা আমরা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম। ...
... কলকাতা পাকিস্তানে থাকলে পাকিস্তানের রাজধানী কলকাতায় করতে বাধ্য হতো, কারণ পূর্ব বাংলার লোকেরা দাবি করত পাকিস্তানের জনসংখ্যায়ও তারা বেশি আর শহর হিসাবে তদানীন্তন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ শহর কলকাতা। ইংরেজের শাসনের প্রথমদিকে কলকাতা একবার সারা ভারতবর্ষের রাজধানীও ছিল। ...
দাঙ্গা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায় ছিল,
...একটা কথা সত্য, অনেক হিন্দু মুসলমানদের রক্ষা করতে যেয়ে বিপদে পড়েছে। জীবনও হারিয়েছে। আবার অনেক মুসলমান হিন্দু পাড়াপড়শীকে রক্ষা করতে যেয়ে জীবন দিয়েছে। আমি নিজেই এর প্রমাণ পেয়েছি। মুসলীম লীগ অফিসে যেসব টেলিফোন আসত, তার মধ্যে বহু টেলিফোন হিন্দুরাই করেছে। তাদের বাড়িতে মুসলমানদের আশ্রয় দিয়েছে, শীঘ্রই এদের নিয়ে যেতে বলেছে, নতুবা এরাও মরবে, আশ্রিত মুসলমানরাও মরবে। ...
অন্যদিকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ষড়যন্ত্রের কথাও তিনি বলেছেন। সেখানেও মূল নায়ক সোহরাওয়ার্দী। বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে বলেন,
‘পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে জনাব সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে দিল্লিতে এক ষড়যন্ত্র শুরু হয়। কারণ, বাংলাদেশ ভাগ হলেও যতটুকু আমরা পাই, তাতেই সিন্ধু, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের মিলিতভাবে লোকসংখ্যার চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা বেশি। সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ রাজনৈতিক জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও কর্মক্ষমতা অনেককেই বিচলিত করে তুলেছিল। কারণ, ভবিষ্যতে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চাইবেন এবং বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কারও থাকবে না। ’
শুধু রাজনীতি কিংবা নিজের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ বাদেও কখনও কখনও বঙ্গবন্ধুর ভেতরের কবি সত্ত্বাও জেগে উঠতে দেখা গেছে এ গ্রন্থে। তাজমহলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভেতরের রোমান্টিকতার প্রকাশ পেয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন,
‘সূর্য যখন অস্ত গেল, সোনালী রঙ আমাশে ছুটে আসছে। মনে হল, তাজের যেন আর একটা নতুন রূপ। সন্ধ্যার একটু পরেই চাঁদ দেখা দিল। চাঁদ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসছে আর সাথে সাথে তাজ যেন ঘোমটা ফেলে দিয়ে নতুন রূপ ধারণ করেছে। কি অপূর্ব দেখতে! আজও একুশ বৎসর পরে লিখতে বসে তাজের রূপকে আমি ভুলি নাই, আর ভুলতেও পারব না। ’
প্রতিটি মানুষের মনে কবি বাস করে। কথাটি হয়ত ঠিক। অপরূপ মায়া ও রোমান্স উঠে এসেছে লাইনগুলোতে।
যাইহোক, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিশক্তিরও বেশ প্রশংসা করতে হয়। প্রতিটি মানুষের নাম। এমনকি কখনও কখনও সময়ও উল্লেখ করেছেন। প্রতিটি ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তিনি অত্যন্ত সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় বর্ণনা করেছেন।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ একটি আত্মজীবনী গ্রন্থ। যে গ্রন্থখানি লেখেছেন একজন নেতা। শুরুতেই বলেছি বঙ্গবন্ধু একজন নেতা। বাংলাদেশ স্বাধীকার আন্দোলনের প্রধান নেতা। নেতার লেখায় রাজনীতি উঠে আসাই স্বাভাবিক। এবং তার রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী একজন নেতার বেড়ে ওঠার গল্প। তার রাজনৈতিক দর্শন ও ভাবনার মিশেলে বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে এ গ্রন্থে। ভাষা ঝরঝরে। বাক্য সাধারণ। শব্দ নির্বাচনে সাদামাটা। কোনো সাহিত্য করার জন্য এ জীবনী তিনি লেখতে বসেননি। নেহায়েত বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী এবং স্ত্রী রেণুর অনুরোধে নিজের জীবন লেখতে বসেছিলেন কারাবন্দী অবস্থায়। যা আজ আমাদের সামনে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ হাজির হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪২ ঘণ্টা, ১৪ আগস্ট, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর