কলকাতা: সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৬ আগস্ট, ১৯২৬, ৩০ শ্রাবণ ১৩৩৩ - ১৩ মে, ১৯৪৭) বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী কিশোর কবির ৮৭তম জন্মদিন আজ বৃহস্পতিবার। বাবা-নিবারন ভট্টাচার্য, মা-সুনীতি দেবী।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের পৈতৃক নিবাস ছিল বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে)। ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন তিনি। এ সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।
সুকান্তের বাল্যবন্ধু ছিলেন কবি অরুনাচল বসু। সুকান্ত সমগ্রতে লেখা সুকান্তের চিঠিগুলোর বেশিরভাগই অরুনাচল বসুকে লেখা। অরুনাচল বসুর মাতা কবি সরলা বসু সুকান্তকে পুত্রস্নেহে দেখতেন। সুকান্তের ছেলেবেলায় মাতৃহারা হলেও সরলা বসু তাকে সেই অভাব কিছুটা পূরণ করে দিতেন। কবির জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছিল কলকাতার বেলেঘাটার ৩৪ হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়িতে। সেই বাড়িটি এখনো অক্ষত রয়েছে।
পাশের বাড়িটিতে এখনো বসবাস করেন সুকান্তের একমাত্র জীবিত ভাই বিভাস ভট্টাচার্য। পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সুকান্তের নিজের ভাতিজা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মম্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। সেই বছর আকাল নামক একটি সংকলনগ্রন্থ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।
সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো: ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি।
পরবর্তীকালে দুই বাংলা থেকেই সুকান্ত সমগ্র নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়। সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পীসঙ্ঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন।
সুকান্তের সাহিত্য-সাধনার মূল ক্ষেত্র ছিল কবিতা। সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম, যন্ত্রণা ও বিক্ষোভ তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু। তাঁর রচনাকর্মে গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাণীসহ শোষণহীন এক নতুন সমাজ গড়ার অঙ্গীকার উচ্চারিত হয়েছে।
রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার বৈপ্লবিক ভাবধারাটি যাঁদের সৃষ্টিশীল রচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, সুকান্ত তাঁদের অন্যতম। তাঁর কবিতার ছন্দ, ভাষা, রচনাশৈলী এত স্বচ্ছন্দ, বলিষ্ঠ ও নিখুঁত যে, তাঁর বয়সের বিবেচনায় এরূপ রচনা বিস্ময়কর ও অসাধারণ বলে মনে হয়। পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যাধিক পরিশ্রমের ফলে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৯৪৭ সালের ১৩ মে কলকাতার যাদবপুরে টিবি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
সুকান্ত ভট্টাচার্য সমাজসেবার ব্রত নিয়ে যখন কাজ করছিলেন, তখন তার নিকটাত্মীয় অন্নদাশংকর ভট্টাচার্য কিশোরবাহিনী গঠন করেছিলেন। ক্রমেই সেই কিশোরবাহিনী পরিচালনার ভার এসে পরে সুকান্তের ওপর। তারপর থেকে সুকান্ত আর কিশোরবাহিনী দু’টি নাম একাকার হয়ে যায়।
সারা অবিভক্ত বাংলাদেশে সহস্রাধিক শাখা গড়ে তোলেন এবং লক্ষাধিক কিশোর-কিশোরীকে নিয়ে এক বিশাল সংগঠন গড়ে তোলেন। সেই কিশোরবাহিনী আজও আছে সেই গৌরব নিয়ে। এখনো সুকান্তের কিশোরবাহিনী সমাজসেবার ব্রত নিয়ে কাজ করে গ্রামে-শহরে।
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তী পর্যায়ে সুকান্তের আবির্ভাব স্মরণীয়। সুকান্তের কবিতায় বিষয় ও বক্তব্যের বহুমাত্রিকতা একটি নতুন সম্ভবনার ইঙ্গিত দেয়। সুকান্ত ভট্টাচার্য বুর্জোয়া রাজনীতির প্রভাব বলয় ভেঙ্গে নতুন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে নিবেদিত থেকে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন, সমাজচেতনা ও মূল্যবোধের জাগরণে নিবেদিত থেকেছেন।
স্বল্প আয়ুর এই কবি পৃথিবীতে চলমান ঘটনা আর রাজনীতিতে সচেতন ছিলেন। কাব্যচর্চার সময় তাঁর খুব দীর্ঘ না থাকলেও তাঁর কবিতা পাঠকের কাছে আগ্রহ সঞ্চার করেছে। গবেষকরা তাঁর কবিতা থেকে নতুন নতুন দিক ও বিষয়কে আবিষ্কার করেছেন। কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়নি তাঁর কবিতা। প্রতিনিয়ত সুষমা ও ব্যঞ্জনায় পুষ্ট হয়ে মাধুর্যমণ্ডিত হয়েছে। সমসাময়িক কবিদের কাব্যশক্তি পাঠককে আকৃষ্ট করেছিল। সেই কবিরা মানবিক মূল্যবোধ ও আশা-নিরাশার দোলাচলে আন্দোলিত হয়ে কবিতাকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখেছেন।
কিন্তু সুকান্তের কবিতা বাস্তবের জগতে প্রবেশ করে জীবনের সুন্দর দিক, পৃথিবীর রূপ রহস্য ও মানবিক কল্যাণ বন্দনায় ব্যাপৃত। জীবন দর্শনজাত তাঁর কবিতায় ব্যঙ্গ বিদ্রূপ, দেশীয় ঐতিহ্য ও সমাজ চেতনার উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়।
সুকান্ত একটি আধুনিক কাব্যভাষার সৃষ্টি করেছেন। এখানেই অন্য কবিদের থেকে তার স্বতন্ত্রতা। তিনি গণমানুষের মুক্তির প্রেরণা সৃষ্টিতে মগ্ন ছিলেন। তাঁর প্রতিবাদী কন্ঠ বাঙ্গালি পাঠককে আকৃষ্ট করে রেখেছে সেই কারণেই। যেহেতু একজন প্রগতিশীল কবি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে বিচ্যুত নন। সেহেতু চলমান ঘটনাপ্রবাহ ও ভবিষ্যতকে তিনি প্রত্যক্ষ করেন সচেতনভাবে। খুব কাছে থেকে দেখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা সুকান্তের কবিচিত্তকে আলোড়িত করে।
দেশে দেশে বিক্ষোভ, নিরন্ন মানুষের হাহাকার ও প্রতিবাদ কবিতায় তুলে ধরে সুকান্ত নতুন ধারার কবিতা রচনা করেন। শিশু সুকান্তের সমাজের দুঃখগাঁথা সেইসব কৈশোরিক অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে অনেক কবিতায়।
ছেলেবেলাতেই তিনি লিখছেন- ‘বল দেখি জমিদারের কোনটি ধাম/জমিদারের দুই ছেলে রাম শ্যাম/রাম বড় ভাল ছেলে পাঠশালা যায়/শ্যাম শুধু ঘরে বসে দুধ ভাত খায়। ’ এই পোড়া দেশে ঘরে বসে যে দুধভাত খাওয়া যায় না, অভাব এসে দাঁড়িয়ে থাকে দরজায়, বিরূপ প্রকৃতি আর শোষণ বঞ্চনা মানুষের প্রতিরোধ শক্তি সঞ্চার করে, মানুষ প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠেন- সেটা কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে।
ক্রমেই বন্ধুদের সান্নিধ্য ও বামপন্থী রাজনীতিবিদদের বক্তব্য, বিবৃতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সুকান্ত কবিতায় বিদ্রূপ ও বিপ্লবী চেতনাকে ধারণ করেন। তাঁর কবিতায় স্বজাতি ও স্বদেশের বিচিত্র রূপ চিত্রিত হয়েছে। তাঁর সৃজনশীলতা পাঠকমহলে তাকে স্বতন্ত্র অবস্থানে নিয়ে গেছে। কিশোর বয়স থেকে লেখালেখি করলেও সুকান্তের কাব্যপ্রতিভার বিকাশ ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে।
বিদেশি শক্তিগুলোর দোর্দণ্ড প্রতাপ, মৃত্যুর বিভীষিকা, অসম প্রতিযোগিতা তার কবিচিত্তকে রক্তাক্ত করে। তার থেকেই ওঠে আসে কবিতা- ‘কেঁদেছিল পৃথিবীর বুক/গোপন নির্জনে/ধাবমান পুঞ্জ পুঞ্জ নক্ষত্রের কাছে/পেয়েছিল অতীত বারতা/মেরুদণ্ড জীর্ণ তবু বিকৃত ব্যথায়/বার বার আর্তনাদ করে/আহত বিক্ষত দেহ মুমূর্ষু চঞ্চল/তবুও বিরাম কোথা ব্যাগ্র আঘাতের। ’ আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা সুকান্তকে আকৃষ্ট করেছিল।
রবিঠাকুরের কবিতার মধ্যে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। লিখেছিলেন- ‘এখনো আমার মনে তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি/প্রত্যেক নিভৃত ক্ষণে মত্ততা ছড়ায় যথারীতি। ’ আর মানবতাবাদ ও বিদ্রোহের সম্মিলন, ভয়াবহ মন্বন্তর, ফ্যাসিস্ট শক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সুকান্ত জ্বলে ওঠেন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে উচ্চকিত হয় তাঁর কন্ঠ।
কবিতায় প্রতিবাদকে তুলে ধরেন ক্ষোভের সঙ্গে- ‘অবাক পৃথিবী। অবাক করলে তুমি/জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি/অবাক পৃথিবী। আমরা যে পরাধীন/অবাক, কি দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন। ’ তার প্রতিবাদ আরও ধ্বনিত হয়- ‘বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে/আমি যাই তার-ই দিনপঞ্জিকা লিখে/এত বিদ্রোহ কখনো দেখিনি কেউ/দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ। ’ ঠিক একইভাবে কলম, চারাগা সিগারেট প্রভৃতি সামান্য বিষয়গুলোও কবির কাছে নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে ধরা দিয়েছে।
আপন বক্তব্যে দুঃখী মানুষের আত্মকাহিনীতে লেখা কবিতা হয়ে যায় বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনাময়- ‘রানার ছুটেছে তাই ঝমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে/রানার চলেছে খবরে বোঝা হাতে রানার চলেছে, রানার/রাত্রির পথে পথে চলে কোন নিষেধ জানে না মানার/দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার-’।
পাঠকরা রানার-এর জীবন কাহিনীতে একাত্ম হয়ে যায়। রোমাঞ্চিত হতে হয় বর্নণার দক্ষতায়।
জীবন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে যারা কবিতা রচনা করেন তারা চরিত্রের সঙ্গে মিশে যান। সুকান্ত তাদেরই একজন। সত্যি বলতে, একটি প্রবন্ধে সুকান্তের কথা লিখে শেষ করা বাতুলতা মাত্র। সুকান্তের লেখাগুলোকে নিয়ে মনে হয় অনন্তকাল লিখে গেলেও শেষ করা যাবে না।
ফরিদপুরের কোঠালিপাড়ায় সুকান্তের পৈতৃক বাড়ি অধিগ্রহণ করে ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা হয়েছে। ভারতে সুকান্তের নিজ হাতে গড়া ‘কিশোরবাহিনী’ এখনো কাজ করে যাচ্ছে ছোটদের নিয়ে। বাংলাদেশে আছে ‘সুকান্ত সংসদ’।
এছাড়াও সুকান্তকে নিয়ে দুই দেশে আছে নানা সংগঠন, বেশকিছু মানুষ। তারাই যা ভরসা।
কিন্তু ভারতে এখনো অধিগ্রহণ করা হয়নি সুকান্তের ‘জন্মভিটে’ বা নিজ হাতে গড়া বন্ধ হয়ে থাকা ‘গ্রন্থাগার’ বা সেই বিখ্যাত বাড়ি, যেখানে তিনি জন্ম দিয়েছেন অনেক কবিতার, সেই বেলেঘাটার ‘৩৪ হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়িটি। সুকান্ত অনুরাগীরা দুই দেশের সরকারের কাছে এই দাবিপূরণের প্রত্যাশা করে। প্রত্যাশা এই কারণেই যে, সুকান্ত নিজেই বলে গেছেন- ‘নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। ’
সূত্র: উইকিপিডিয়া
বাংলাদেশ: ০৯০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১২
আরডি/ সম্পাদনা: নজরুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর