ঢাকা: ছোট্ট উঠোন পেরিয়ে একতলা ঘর। সামনে খোলা বারান্দা।
এক কোণে বসেছেন রুবা আর টুংটাং। ওরা দু’বোন। এ দু’বোনকে ঘিরেই আবর্তিত অন্য এতোগুলো প্রাণ।
বয়সে সবাই তরুণ। সবেমাত্র কৈশোর পেরিয়েছেন কেউ কেউ। তারুণ্যের উচ্ছ্বলতা ওদের কাছে একটু ভিন্ন রকম। সময়ে অসময়ে ঘুরে বেড়ানো আর রাতভর জেগে আড্ডা দেওয়া নয়। ফেসবুকে চ্যাট কিংবা মুঠোফোনে আলাপচারিতাও নয়। সময়কে ওরা মাতিয়ে তোলেন একটু অন্যভাবে। একান্তই নিজেদের মতো করে। গান, কবিতা, নাটক, একটু আধটু খেলাধুলা আর কম্পিউটারের সঙ্গে ওরা তারুণ্যের উদ্দাম আনন্দকে বিলিয়ে দিয়েছেন।
ওরা সবাই ইনার আইস মিউজিক ইন্সটিটিউশন ফর ব্লাইন্ডস’র সদস্য। চোখে দেখেন না কেউ। তবে মনের চোখে বিশ্ব জয়ের স্বপ্নে বিভোর। মন দিয়ে তারা দেখে নেন পৃথিবীর যতো আলো। ওদের মনের আলো ছড়িয়ে পড়ে আলোর পৃথিবীতে।
ইনার আইস মিউজিক ইন্সটিটিউশন ফর ব্লাইন্ডস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের মেড্ডায় অবস্থিত। একজন আলোর মানুষের হাতে গড়ে ওঠা অনন্য প্রতিষ্ঠান। ওস্তাদ আফজালুর রহমান। তার নিজের চোখেও আলো ছিল না। কিন্তু মনের আলোর প্রখরতা ছিল প্রচণ্ড তীব্র। দৃষ্টিহীন হয়েও দৃষ্টিমানদের চেয়েও এগিয়ে ছিলেন অনেক বেশি। আর তাইতো আফজালুর রহমান দৃষ্টিহীনদের জন্য ১৯৮০ সালে গড়ে তুলেছেন এ প্রতিষ্ঠানটি।
এখানে দৃষ্টিহীনরা তাদের আলো ছড়ানো শিখবেন, বিকাশ ঘটাবেন লুকিয়ে থাকা সব প্রতিভার, এমন স্বপ্নেই এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছিলেন আফজালুর রহমান। ওস্তাদ আফজালুর রহমানের দু’মেয়েও দৃষ্টিহীন। তিনি মারা যাওয়ার পর থেকে মেয়েদের হাতেই এগিয়ে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি।
অসম্ভব তারুণ্য ঢেউ খেলে যায় রুবা আর টুংটাংদের মাঝে। তারুণ্যের পাল তোলা এ নায়ে এখন একদল যাত্রী। গান, কবিতা আর বাদ্যযন্ত্র শিখেই ওদের সময় কেটে যায়। মজার ব্যাপার হলো, ওসব কিছু শেখাতে ওদের কোনো দৃষ্টিমান শিক্ষক নেই। কম্পিউটারের মতো যন্ত্রও ওরা সুনিপুণভাবে শিখে নেন দৃষ্টিহীন শিক্ষকদের কাছ থেকে। অনাবিল আনন্দে ওরা শিখে নেন সবকিছু।
রুবা আর টুংটাংয়ের বয়স পঁচিশের কোঠায়। হৃদয়ভরা স্বপ্ন ওদের। এ স্বপ্ন তারুণ্যের। এ স্বপ্ন দিয়ে ওরা গড়ে তুলতে চান দৃষ্টিহীনদের জন্য পূর্ণাঙ্গ এক প্রতিষ্ঠান। দৃষ্টিহীনদের যেন আর কোনোদিন কেউ অক্ষম না বলতে না পারেন, সেটাই প্রমাণ করতে চান রুবা আর টুংটাং।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এ স্বপ্ন তারুণ্যে ভরপুর এ দু’বোন হেঁটে যাচ্ছেন অনবরত। একদিন সব বাধা জয় করার দীপ্তি ঝরে পড়লো ওদের কণ্ঠ থেকে। বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘‘আমরা প্রমাণ করতে চাই, আমরা অক্ষম নই। কারো করুণার পাত্র হতে চাই না। অধিকার আদায়ে সোচ্চার হবো। ’
বিশ্বখ্যাত স্যাটেলাইট চ্যানেল আল-জাজিরা টিভিও ইনার আইস মিউজিক ইন্সটিটিউট নিয়ে কয়েক বছর আগে নির্মাণ করে গেছে একটি প্রামাণ্যচিত্র। আধা ঘণ্টার এ প্রামাণ্যচিত্রটি বিশ্বব্যাপী প্রচার করেছে চ্যানেলটির কর্তৃপক্ষ। থেমে নেই রুবাদের যাত্রা। এরই মধ্যে ওরা ঘুরে এসেছেন জাপান থেকে। ওখানকার একটি সেমিনারে জোর গলায় বলে এসেছেন ‘‘দৃষ্টিহীনরা অক্ষম নয়, কখনো কখনো দৃষ্টিমানদের চেয়েও অধিক সক্ষম। ’’
স্বপ্নভরা ইনার আইস মিউজিক ইন্সটিটিউট ফর ব্লাইন্ডসের সদস্যরা তারুণ্যের ঢেউয়ে ভাসিয়ে দিতে চান অপূর্ণতা। স্বপ্ন দিয়ে সাজাতে চান চারপাশের সবকিছু। চোখে আলো নেই, তাতে কি? মনে যে আলোর ঝলকানি নিত্য খেলা করে যায়, সে আলোয় একদিন ঠিকই ভূবন ভরিয়ে দেবেন ওরাও।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১২
এমএ/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর